কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর। এর উত্তর-পশ্চিমে বুলর হ্রদ। এই হ্রদের প্রাচীন নাম মহাপদ্ম। বিতস্তাসহ বেশ কয়েকটি নদীর জল এই হ্রদে এসে পড়ে। পরে সেখান থেকে জলপূর্ণ বিতস্তা উল্টোদিকে প্রবাহিত হয়। অনেক সময় এই হ্রদে প্রচুর পরিমাণে জল জমে যেতো। পথ না পেয়ে এই জল সহজে বেরোতে পারতো না। সেজন্য বর্ষাকালে কাশ্মীরে বন‍্যা হতো। এর জেরে নষ্ট হতো ক্ষেতের ফসল। আর এর অনিবার্য পরিণতিতে দেখা দিতো দুর্ভিক্ষ। কাশ্মীররাজ ললিতাদিত‍্য (আনুমানিক ৭২৫-৬১ খ্রি: )সহ বেশ কয়েকজন রাজা বিতস্তার খাদে জল বের করার ব‍্যবস্থা করেও স্থায়ীভাবে সফল হোননি। পরবর্তীকালে উৎপল বংশীয় প্রথম রাজা অবন্তিবর্মা (৮৫৫-৮৮৩ খ্রি: )-র আমলে বন‍্যার ফলে এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় কাশ্মীরে। এর ফলে সেখানে খাদ‍্যশস‍্যের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণেরও বেশি বেড়ে যায়। এক খারী ধানের স্বাভাবিক দাম যেখানে ছিল দুশো দিন্নার, দুর্ভিক্ষের সময় তা বেড়ে হয়েছিল এক হাজার পঞ্চান্ন দিন্নার। ঐতিহাসিক অরেল স্টাইনের ( Aurel Stein) মতে দিন্নার মানে "কড়ি।"

দুর্ভিক্ষের তাড়নায় কাশ্মীরের মানুষ থেকে রাজা, সবাই যখন দিশেহারা, তখন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন এক অনাথ যুবক। নাম---সূর্য। এ সম্পর্কেও কিছু ইতিহাস রয়েছে। এক চণ্ডাল নারী পথে একটি অনাথ শিশু কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল "সূর্যা।" সূর্যা তাঁর এই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর নাম রাখেন নিজের নামে "সূর্য।" পালিতা মা সূর্যা তাঁর এক প্রতিবেশিনী শূদ্র নারীর সহায়তায় সূর্যকে লালন-পালন করেন। ক্রমে সূর্য বড়ো হয়ে লেখাপড়া শেখেন। এরপর তিনি এক গৃহস্থ বাড়িতে ছেলেদের শিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হোন। সূর্য তার বন্ধুদের কাছে কথাচ্ছলে বলতেন, সুযোগ পেলে তিনি দেশের দুর্ভিক্ষ দূর করতে পারেন। তবে অর্থের অভাবের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না। সকলেরই তাঁর কথাকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতো। কেউই গুরুত্ব দিতো না।

শেষ পর্যন্ত কথাটা রাজা অবন্তিবর্মার কানে গেল। তিনি সূর্যকে ডেকে পাঠালেন, মন দিয়ে তাঁর কথাও শুনলেন। শেষে তাঁর বুদ্ধির পরীক্ষার জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দ করলেন। রাজার অনুমতি পেয়ে কাজে লেগে গেলেন সূর্য। দেখা গেল, আশেপাশের পাহাড় থেকে প্রচুর পাথর পড়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় বিতস্তার জলস্রোত আটকে গেছে। এর ফলে বন‍্যা দেখা দিয়েছে। সূর্য দেখলেন, দুটি জায়গার পাথর সরিয়ে ফেললেই জল নেমে গিয়ে বন‍্যা বন্ধ হয়ে যাবে। সূর্য রাজকোষ থেকে বরাদ্দ প্রচুর পরিমাণে দিন্নার এনে জলের মধ্যে ওই দুটি জায়গায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন। নদীর জলে দিন্নার ফেলার খবর শুনে চারপাশ থেকে ছুটে এলো দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের দল। তারা জলে নেমে পাথর তুলে ফেলে দিন্নার খুঁজতে লাগলো। এভাবেই বিতস্তার গর্ভ থেকে পাথরের বাধা সরে গেল। এর পর দু'তিন দিনের মধ্যেই বন‍্যার জল নেমে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল।

এরপর সূর্য পাথরের একটি অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে সাত দিনের জন্য বিতস্তা নদীর স্রোতকে সাময়িকভাবে আটকে দিলেন। এর ফলে নদীর তলদেশ জলশূন‍্য হয়ে শুকিয়ে গেল। এরপর নদীর দু'পাশ পাথর দিয়ে এমনভাবে বাঁধিয়ে দিলেন, যাতে দু'পাশ থেকে ধ্বস নেমে নদীখাত বুজে যেতে না পারে। এরপর অস্থায়ী বাঁধ ভেঙে ফেলে নদীপথ স্বাভাবিক করা হলো। এছাড়াও যে সব জায়গায় নদী ভাঙন দেখা দিতো, সেসব জায়গায় খাল কেটে নদীর গতিপথ পাল্টে দেওয়া হলো। এর আগে ছোট সিন্ধু পূর্বে ত্রিগামীর কাছে (অধুনা ত্রেগাঁও) বিতস্তার সঙ্গে মিলিত হতো। সূর্যের নতুন নদী পরিকল্পনার ফলে বিতস্তা-সিন্ধুর মিলিত সঙ্গমস্থলটিকে খাল কেটে নিয়ে আসা হয় আজকের শাদীপুরের কাছে। এর ফলে এলাকায় বন‍্যা দূর হয়।

সূর্যের নাম আমরা অনেকেই জানি না। কিন্তু খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লেখা কাশ্মীরি পণ্ডিত কলহনের "রাজতরঙ্গিণী" গ্রন্থে এই সূর্যের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। কলহন বলছেন, স্বয়ং অন্নদাতা সূর্যরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এই মর্ত্যের মাটিতে। যে কাশ্মীরে সুদিনের সময় দুশো দিন্নার ছাড়া এক খারী ধান পাওয়া যেতো না, সূর্যের কর্মদক্ষতায় সেই কাশ্মীর এলাকায় মাত্র ছত্রিশ দিন্নারে এক খারী ধান বিক্রি হতে লাগলো। তাই কাশ্মীরের ইতিহাসে সূর্য এক সার্থক কর্মবীরের নাম হিসেবে উল্লেখযোগ্য।