"বিড়াল বলে, মাছ খাবো না, আঁশ ছোঁব না, কাশী যাবো।" তা বিড়ালের আগে না হয় আমরাই কাশী যাই। দেখা যাক, বহুচর্চিত কাশীর বিষয়-আশয়। প্রায় চার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে আজও অমলিন কাশী। বলা হয়, কাশীর প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং দেবাদিদেব শিব। তিনটি ছোট্ট পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কাশী, যা শিবের ত্রিশূলের তিনটি ফলা বলে গণ‍্য করা হয়। কাশীতেই বাস করেন শিব। আছেন দেবী অন্নপূর্ণা। কাশী তাই প্রাচীন হিন্দু তীর্থ।

একসময় কাশী থেকে স্নাতক ছাত্ররা তক্ষশীলায় যেতো ক্লাস নিতে এবং তক্ষশীলা থেকে স্নাতকরা ক্লাস নিতে আসতো কাশীতে। কাশীর প্রথম শাসক বলে কথিত রেণু কুরু ও পাঞ্চাল জয় করে এখানেই অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। বৌদ্ধযুগে কাশীর কাছেই গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধকাশী সারনাথ‌। এই সারনাথের কাছ থেকেই পাওয়া "সিংহ" ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়েছে। কাশীর যে নগরী, তার নাম "বারাণসী।" বৌদ্ধ জাতক অনুসারে, বারাণসীর শ্রেষ্ঠীরা প্রতিদিন এক মণ ( প্রায় ৩০ কেজি) রুপো ও তামার মুদ্রা লেনদেন করতেন। এ থেকেই বোঝা যায়, এলাকা কতটা সমৃদ্ধশালী ছিল। বরুণা ও অসি নামে দুটি নদীর মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত "বারাণসী।" ব্রিটিশরা বারাণসীকে করেছে "বেনারস।"

কথায় আছে, "বার্ধক্যে বারাণসী।"

সংস্কৃত "কুশ" থেকে এসেছে শব্দ "কাশী", যার অর্থ---আলোকিত করা। দেবাদিদেব শিবের আলোয় আলোকিত কাশীধাম। আবার কথিত আছে, "কাশ" নামে এক পৌরাণিক যুগের শাসকের নাম থেকে এসেছে "কাশী", বৈদিকযুগে যে বংশের শাসক ছিলেন ঋগ্বেদে উল্লিখিত দিবোদাস।

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আলফ্রেড কানিংহামের নেতৃত্বে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালানো হয় এবং সে সময় রাজঘাট মালভূমির কাছে "ঋষিপত্তন" নামে এক প্রাচীন জনপদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননেই প্রমাণিত, গঙ্গার উত্তরে রাজঘাটের কাছে মালভূমি থেকে উৎপত্তি হয়ে গঙ্গায় এসব থেমে গেছে শহর বারাণসী। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে রাজঘাট মালভূমি থেকে পাওয়া গেছে প্রাচীন বারাণসী শহরের ধ্বংসাবশেষ এবং এর ফলে জানা গেছে খ্রিস্ট পূর্ব অষ্টম শতক থেকে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত প্রায় বারোশো বছরের ইতিহাস। কাশীর বিখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দির। প্রাচীন মন্দিরের চূড়া ছিল ১৫১ ফুট উঁচু। কিন্তু মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে মূল বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করে দেন। সে সময় নির্যাতনের আশংকায় মন্দিরের পুরোহিত বিগ্রহকে গঙ্গায় ফেলে দেন এবং এরপর নিজেও আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে সাংকেতিক ভাষায় লিখে যান বিগ্রহের ঠিকানা। এছাড়াও আওরঙ্গজেব কাশীর একটি শিবমন্দিরকে জ্ঞানবাপী মসজিদে রূপান্তরিত করেন বলে জানা যায়।

এরপর আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭) অনেক পরে নতুন করে প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাশে তৈরি হয় বিশ্বনাথ মন্দির এবং পুরোহিতের সাংকেতিক চিঠি অনুসারে বিগ্রহ পুনরূদ্ধার করে মন্দিরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন। কাশীর বিশ্বনাথ "বিশ্বেশ্বর" নামেও পরিচিত। কথিত আছে, পাঞ্জাবের শাসক মহারাজা রণজিৎ সিংহ মুসলমানদের কাছ থেকে পাওয়া প্রচুর পরিমাণে মুক্তিপণ দান করে দেন মন্দিরে। দানের শর্ত হিসেবে মন্দিরের চূড়া সোণা দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয় এবং সেজন্য এটি "স্বর্ণমন্দির" নামেও অভিহিত। বর্তমান বিশ্বনাথ মন্দিরটি ৫১ ফুট উঁচু এবং মন্দিরের ভেতরের ঘন্টাটি দান করেন নেপালের রাজা। কাশীতে আছে "পঞ্চকোশী", অর্থাৎ ৫ ক্রোশ পথ, যা তীর্থযাত্রীদের পায়ে হেঁটে পরিক্রমা করার নিয়ম। অন্যথায়, কাশীতীর্থ অসম্পূর্ণ। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীতে কাশী আক্রমণ করেন মহম্মদ ঘোরি।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কাশীর মহারাজা হোন মনসা রাম। তাঁর আমলেই কাশীতে মুসলমান আক্রমণের ইতি ঘটে। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র বলবন্ত সিংহ গঙ্গা জুড়ে তৈরি করেন শক্তিশালী রামনগর দুর্গ, যা ভেদ করে মুসলমানদের পক্ষে কাশী আক্রমণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটে সতীর কানের কুণ্ডল পড়েছিল বলে স্থানটি হিন্দুদের কাছে পবিত্র।