এ দেশে বেশ কিছু জাতির মানুষ রয়েছেন, যাঁরা পুরো হিন্দুও নন, আবার পুরো মুসলমানও নন। হিন্দু-মুসলমানের মাঝামাঝি একটা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ঝুলে আছেন তাঁরা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মালকানা রাজপুত, চিত্রকর বা পটুয়া। এই পটুয়াদের আচার-আচরণ-বিয়ের প্রথা হিন্দুদের মতোই। ইতিহাস বলছে, এঁরা প্রায় চারশো বছর আগে মুসলমান হয়ে যান, কিন্তু সংস্কারে এখনো রয়ে গেছে হিন্দুত্ব। এইসব জাতির লোকজন সমাজে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছেন।

এরপরের ঘটনা কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটে। তথাকথিত সমাজপতিদের বিচারে সমাজের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার নামে ওইসব মেয়ে হারানো পরিবারের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের জাতিচ‍্যুৎ করা হয়েছে। এজন্য তাদের গায়ে তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে "মগো বামুন", "মগো কায়েত", "মগো বৈদ‍্য", "মগো নাপিত" বিশেষণে। পূর্ববঙ্গের যশোর, খুলনা, ফরিদপুর এলাকায় থাকা "মগো"-দের ঘরে ব্রাহ্মণরা জলস্পর্শ করতেন না।

এ বিষয়ে একটি ঘটনার খবর সেকালের কাগজে বেরিয়েছিল। ঘটনাটি এইরকম: পূর্ববঙ্গের যশোর বার লাইব্রেরিতে একজন "মগো কায়েত" উকিল ছিলেন। বার লাইব্রেরিতে তাঁর আলাদা পানীয় জলের জায়গা নির্দিষ্ট ছিল। একদিন তিনি "ভুল করে" (? ) খাঁটি উচ্চবর্ণের জন্য রাখা নিদিষ্ট জায়গা থেকে জলপান করে ফেলেন। ব‍্যস, আর যাই কোথায়? বার লাইব্রেরি মুহূর্তেই যেন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠলো। উচ্চ বর্ণের উকিলরা এজন্য ওই "মগো কায়েত" উকিলের গালাগালি থেকে বচসা এবং শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে জড়িয়ে যান। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। একইভাবে হিন্দু সমাজে "বর্ণ ব্রাহ্মণ"রা শূদ্র জাতির পৌরহিত‍্য করার অপরাধে পতিত ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত হয়ে যান। এরকমভাবে গণক ঠাকুর বা গ্রহবিপ্র ও গৃহস্থের গোয়ালে মৃতজনের শ্রাদ্ধের পিণ্ড ভক্ষণ করা অগ্রদানী ব্রাহ্মণরাও পেশাগত কারণে পতিত হয়েছেন। এভাবেই নতুন নতুন পেশাগত বা বৃত্তিগত ভিত্তিতে জাতি তৈরি হয়ে হিন্দু সমাজ আরও টুকরো টুকরো হয়েছে।

মূল হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এইসব জাতির লোকজনদের স্বধর্মে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। তিনি তাঁর শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু থেকে নামমাত্র মুসলমান হয়ে যাওয়া বহু মালকান রাজপুতকে পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে এনে সমাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। এছাড়া শ্রীচৈতন্য পার্ষদ নিত‍্যানন্দ-পুত্র বীরচন্দ্র ( বা বীরভদ্র ) গোস্বামী অসম ও মণিপুরের বিভিন্ন পাহাড়িয়া জাতির মধ্যে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার করে তাঁদের মূল হিন্দুধর্মে সামিল করেছিলেন। কিন্তু এরপর বৈষ্ণবধর্ম প্রচারকরা এই নীতি অনুসরণ করেন নি। তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলে ওইসব অঞ্চলে হিন্দুরা আরও ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো।

মোগলদের আক্রমণ থেকে টিকে থাকতে একসময় পঞ্জাবের নবম শিখগুরু গুরু গোবিন্দ সিং শিখদের সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সেখানকার ব্রাহ্মণ, জাঠ, রাজপুত---সকলকে নিয়ে গড়ে তোলেন এক অখণ্ড শিখ সমাজ। কিন্তু ব্রাহ্মণ‍্যবাদী হিন্দু সমাজ পঞ্জাবের শিখদের এতটা সাম‍্যবাদ মানতে পারলেন না। এর ফলে পঞ্জাবের হিন্দু সমাজ শেষ পর্যন্ত দু'টুকরো হয়ে গেল। শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের প্রচারিত ধর্মের মধ্যে কোনো জাতিভেদ ছিল না।

তাই শিখরা ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছেন, দেশের অন্যান্য অংশের হিন্দুরা পারেন নি। এর ফলে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে হিন্দু শক্তি, নষ্ট হয়েছে ঐক‍্য, যার পরিণতিতে বার বার বিদেশি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়ে মূল্য চোকাতে হয়েছে ভারতকে। পরিণতিতে ভারতীয়দের কপালে জুটেছে পরাধীনতা। আজও হিন্দু সমাজ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, যা দেখে একটা কথাই স্পষ্ট হয়, ইতিহাস থেকে আমরা একটা জিনিসই শিখি এবং তা হলো, আসলে ইতিহাস থেকে আমরা কিছুই শিখি না।

জাতিভেদ: দিগিন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য