খ্রিস্টিয় চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতক সময়ের ভারতবর্ষ। চোরের উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজা বিক্রমাদিত্য থেকে প্রজাদের দল। রাজধানীতে একের পর এক ঘটছে চুরির ঘটনা। রাজা বিক্রমাদিত্য নিজে নগরপালকে ডেকে চোর ধরতে বললেন। কিন্তু কোথায় চোর! চুরি ক্রমশ বেড়েই চললো। এবার ছদ্মবেশে রাজা বিক্রমাদিত্য নিজেই বের হলেন চোরের সন্ধানে। এজন্য রাজধানীর চৌরাস্তার এক পাশে লুকিয়ে রইলেন তিনি। একসময় নি: ঝুম হয়ে এলো রাজপথ। রাজা কিন্তু জেগে। একসময় গভীর রাতে রাজা বিক্রমাদিত্য দেখলেন, চারদিক থেকে চারজন নিরীহ গোছের লোক এসে দাঁড়ালো চৌরাস্তায়।

রাজা বিক্রমাদিত্যর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো। তিনি ইশারায় লোকগুলিকে কাছে ডাকলেন। তারা আস্তে আস্তে রাজা বিক্রমাদিত্যের কাছে এসে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলো। বিক্রমাদিত্য উত্তরে বললেন, তাঁর নাম প্রজাপাল। নিজেও একজন চোর। সঙ্গীর জন্য অপেক্ষায় আছেন। লোকগুলি বললো, তাঁকে তারা দলে নিতে চায়। এক ব‍্যবসায়ী বিদেশে বহু ধনদৌলত কামিয়ে ঘরে ফিরেছে। তার বাড়িতেই আজ দাঁও মারতে যাচ্ছে তারা। প্রজাপাল সঙ্গে চলুক। বিক্রমাদিত্য বুঝে গেলেন, এরা সব চোরের দল। মুখে বললেন, তেল-লংকা বেচে ব‍্যবসায়ী আর কত টাকাই বা করেছে। তার চেয়ে রাজবাড়িতে চুরি করলে ঢের লাভ। চোরের দল বললো, রাজপ্রাসাদে চুরি করা অনেক বিপদের কাজ।

হাঁটতে হাঁটতে সবাই হাজির রাজপ্রাসাদের সামনে। রাজপ্রাসাদে ঢোকার আগে বিক্রমাদিত্য জানালেন, প্রত‍্যেকের কার কি দক্ষতা আছে, জানা দরকার। প্রথম চোর জানায়, ঘরের ভেতরে কি আছে, তা আমি বাতাস শুঁকেই বলে দিতে পারি। দ্বিতীয়জন বললো, আমি হাত দিয়ে সমস্ত তালা খুলে ফেলতে পারি। তৃতীয় চোর জানালো, আমি যার গলা একবার শুনি, কখনও তাকে ভুলি না। পঞ্চমজন বললো, আমি পশুপাখির ভাষা বুঝতে পারি। এবার চারজন চোর বিক্রমাদিত্যের দক্ষতার কথা জানতে চাইলো। উত্তরে বিক্রমাদিত্য জানালেন, ধরা পড়লে রাজদণ্ড এড়ানোর ক্ষমতা তাঁর আছে। চোরেরা বললো, তাদের ওই রাজদণ্ডকেই বড়ো ভয়! এরপর চোরের দল ছদ্মবেশী বিক্রমাদিত্যকে সঙ্গে নিয়ে রাজপুরীতে ঢুকলো। তারপর প্রত‍্যেকেই একটি করে সোণাদানার বাক্স তুললো। হঠাৎই দূরে একটা ডেকে উঠলো শেয়াল।

শুনে তৃতীয় চোর বললো, তোমরা সবাই থামো। শেয়াল বলছে, ঘরের মালিক সব দেখছে। কোন্ সাহসে তোমরা চুরি করতে এসেছো! আজ বরং ফিরে যাওয়াই উচিত। চোরেরা কিছুটা ঘাবড়ে গেল। তখন বিক্রমাদিত্য বললেন, এই রাজপ্রাসাদের মালিক রাজা তো এখন ঘরের সাততলায় শুয়ে আরামে ঘুমোচ্ছেন! তথাকথিত প্রজাপালের কথায় মনের জোর পেল তারা। এরপর পাঁচজনে পাঁচটি সোণাদানার বাক্স চুরি করে নিলো। এমন সময় বাইরে ফের শেয়ালটা ডেকে উঠলো। এবার শেয়ালটা একটি কুকুরকে জিজ্ঞেস করলো, রাজকোষ থেকে চুরি হচ্ছে দেখে কুকুর এখনো নীরব কেন? কুকুর জানালো, মালিক নিজেই সবকিছু দেখছেন। সুতরাং, তার কিছুই করার নেই। চোরেরা আবার ঘাবড়ে গেল। এবারেও বিক্রমাদিত্য তাদের অভয় দিলেন, তিনি থাকতে কোনো ভয় নেই। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে ফের সবাই হাজির সেই চৌরাস্তায়। সবাই একটি করে বাক্স ভাগে পেয়ে বেজায় খুশি।

এটি প্রজাপালের জন্যই সম্ভব হয়েছে। সেজন্য তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো চোরেরা। এরপর পরের দিন ওই পুরোনো জায়গায় মিলিত হবার ইচ্ছে প্রকাশ করে বিদায় নিলো তারা। ঠিক হলো, চেনার সুবিধের জন্য সবাই একটি করে লেবু হাতে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে। রাজা বিক্রমাদিত্য ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে সকাল হতেই রাজবাড়িতে রীতিমতো হৈ চৈ। রাজকোষের অধ‍্যক্ষ দেখলেন, রাজকোষ থেকে চুরি গেছে পাঁচ বাক্স সোণাদানা। অধ‍্যক্ষের মাথায় চট্ করে একটি বুদ্ধি এলো। তিনি নিজে একটি বাক্স সরিয়ে রেখে মোট ছয়টি বাক্স চুরি হয়েছে বলে ঘোষণা করলেন। খবর গেল রাজা বিক্রমাদিত্যের কানে। তিনি নগরপালকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, এতদিন ব‍্যবসায়ীদের ঘরে চুরি হচ্ছিল। এখন রাজার ঘরে চুরি! অবিলম্বে চোর ধরতে না পারলে প্রহরীকেই রাজদণ্ড ভোগ করতে হবে।

নগরপাল ঘরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে রাজার কাছে আত্মসমর্পণ কর‍লেন। জানিয়ে দিলেন, তিনি সত্যিই ব‍্যর্থ। এরজন্য রাজদণ্ড মাথা পেতে নিতে চান। রাজা বিক্রমাদিত্য নরম হলেন। তারপর বললেন, সন্ধের পর নগরের চৌরাস্তায় লেবু হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে চারজন লোক। তাদের ধরে আনতে হবে। নগরপাল চারদিকে ছদ্মবেশী সেপাই মোতায়েন করলেন। তারপর চারজন চোরকে ধরে এনে হাজির করলেন রাজার সামনে। রাজা বিক্রমাদিত্য জানালেন, রাজকোষ থেকে ছয়টি সোণাদানার বাক্স চুরি গেছে। সেগুলি জমা করতে হবে। নচেৎ প্রাণদণ্ড হবে তাদের। চোরেরা কিছুতেই চুরির কথা স্বীকার করলো না। এরপর রক্ষীরা তাদের প্রাণদণ্ডের জন্য বধ‍্যভূমিতে নিয়ে চললো।

পথে যেতে যেতে তৃতীয় চোর সঙ্গীদের বললো, আমি গলা শুনেই বুঝেছি, গতকালের সঙ্গীটি ছিলেন রাজা স্বয়ং।

এরপর রাজা বিক্রমাদিত্য তাদের সবাইকে একশোটি করে গ্রামের জমিদারি দিলেন। অন্যদিকে, শাস্তি দেওয়া হলো রাজকোষের লোভী অধ‍্যক্ষকে। বাইরের চোরের দল চিনিয়ে দিয়ে গেল ঘরের চোরকে !

তথ্যসূত্র: