আগেই খোরাসান, পারস্য, ইরান, মসুল ও সিরিয়া থেকে বৌদ্ধরা নির্মূল হয়েছিল মুসলমান আক্রমণে। এরপর ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সিন্ধু উপত্যকায় মহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে শুরু হয় বিধর্মীদের ওপর প্রবল আক্রমণ। কাশিমের হঠাৎ আক্রমণে ব্রাহ্মণাবাদ ও মূলতানের মানুষ ভীত সন্ত্রন্ত হয়ে ওঠে। কাশিম অসংখ্য অমুসলমান পুরুষদের হত্যা করে, ধনসম্পদ লুঠ করে তাদের নারী ও শিশুদের বন্দি করে ক্রীতদাসে পরিণত করে। এরপর হিন্দু প্রজাদের ওপর চালু করে বশ‍্যতা কর "জিজিয়া" ও ভূমিকর "খারাজ।" "জিজিয়া" ছিল অমুসলমান প্রজাদের ওপর ধার্য কর। আর ভূমিকর হিসেবে চালু ছিল "খারাজ।" মুসলমান শাসনের আগেও ভারতবর্ষে ভূমিকর চালু ছিল। তবে তার পরিমাণ ছিল কম। হিন্দু আইনে সাধারণত: উৎপাদিত ফসলের ৬ ভাগের ১ ভাগ থেকে জমির উর্বরতা ও সেচের সুবিধা অনুয়ায়ী ১২ ভাগের ১ ভাগ ছিল ভূমিকর।

ভূমিকরের পরিমাণটা পাল্টে অতিরিক্ত হয়ে যায় মুসলমান আমলে। ইরাকে খলিফা ওমরের যে পরিমাণ "খারাজ" ধার্য ছিল, ভারতেও সেই পরিমাণ ধার্য করা হয়। এর ফলে যে জমিতে সরকারি নালার মাধ্যমে জলসেচের ব‍্যবস্থা ছিল, সেইসব জমিতে গম ও বার্লির ক্ষেত্রে "খারাজ" ধার্য হয় উৎপাদিত ফসলের ৫ ভাগের ২ ভাগ। আর কৃত্রিম উপায়ে জলসেচের ব‍্যবস্থা থাকলে সেই জমিতে "খারাজ" দিতে হতো ১০ ভাগের ৩ ভাগ। আবার অসেচ এলাকার জমির জন্য ভূমিকর বরাদ্দ ছিল ৪ ভাগের ১ ভাগ। বলা বাহুল্য, সবটাই নির্ধারিত হয়েছিল ইরাকে খলিফা ওমরের ঘোষিত পরিমাণ অনুযায়ী। সুতরাং, বলা যায়, ভারতের সিন্ধু উপত্যকায় মহম্মদ বিন কাশিমের শাসন আসলে ছিল বিদেশি আরব শাসন, তা কখনোই ভারতীয় ছিল না। এর ফলে সিন্ধু উপত্যকায় বংশপরম্পরায় যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী হিন্দুরা তাদের পৈতৃক ভিটেটেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়।

এর পরিণতিতে ভারতের হিন্দুদের মনে অনুপ্রবেশকারী বিদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৈরি হয় বিদ্বেষ। এর সাক্ষী মুসলমান ঐতিহাসিক আল্-বেরুণি (১০৩০ খ্রি: )। আল্-বেরুণি লিখছেন, এ সব ঘটনা তীব্র ঘৃণা জাগিয়েছে ভারতীয়দের মনে। ...মুসলমান অধিকৃত এলাকার হিন্দুরা পরিণত হয় 'ধুলিকণা'-য় এবং যারা বেঁচে ছিল, তাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে যায় মুসলমানদের সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা। এর ফলে মুসলমানদের বিষয়ে কথাবার্তা, তাদের পোশাক ও আচার-আচরণের উদাহরণ দিয়ে হিন্দুরা তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভয় দেখাতো। বলা বাহুল্য, শিশুরা দুষ্টুমি করলে বাবা-মায়েরা তাদের এই ভয় দেখাতো।

রূপকথার রাক্ষস-খোক্ষসের জায়গায় ওই শিশুর বাবা-মায়েরা মুসলমান হানাদারদের বসিয়েছিল।

এভাবেই বিদেশি মুসলমান হানাদারদের সম্পর্কে ভয় দেখিয়ে হিন্দুরা ঘুম পাড়াতো তাদের দুষ্টু শিশুদের। এর জন্য দায়ি ভারতের মাটিতে একের পর বিদেশি মুসলমান আক্রমণ, হিন্দু গণহত্যা, ক্রীতদাস তৈরির মতো জিহাদি ঘটনা। এ সবের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এ দেশের হিন্দুদের বিদেশি আক্রমণকারীদের সম্পর্ক তিক্ত করে তুলেছিল। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু আক্রমণ থেকে ১৯৪৭-এর দেশভাগ---সবটাই সেই যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা পারস্পরিক অবিশ্বাসের ফল।"হিস্ট্রি রিপিটস্ ইটসেলফ্" অর্থাৎ ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশিমের সময়কার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ১৯৪৭-এ দেশভাগে। পাকিস্তান কি সেই জিহাদের ফসল, প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।