সময়কাল: ৭৮ থেকে ১০২ খ্রিস্টাব্দ।

কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের রাজধানী এই পুরুষপুর। লোকে বলে, তিনি "দেবপুত্র" এবং তিনি দৈবশক্তির অধিকারি ছিলেন বলে লোকের বিশ্বাস ছিল। সম্রাট কনিষ্ক একদিন দূত মারফৎ বিভিন্ন রাজাদের দেওয়া উপহার সামগ্রীগুলি দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর নজর গেল, এক থান কাপড়ের দিকে। এত সুন্দর কাপড় ইতিপূর্বে তিনি দেখেন নি। কাপড়টি পাঠিয়েছেন কান‍্যকুব্জের রাজা। ওই কাপড়ের থানটি দিয়ে তাঁর রাজপোষাক তৈরি করতে চাইলেন কনিষ্ক। সঙ্গে সঙ্গে পুরুষপুরের সবচেয়ে দক্ষ দর্জিকে ডেকে কাপড়ের থানটি দিয়ে রাজপোষাক তৈরি করতে বললেন। দর্জি কাপড় নিয়ে চলে গেল। এক সপ্তাহ কেটে গেল। দর্জির দেখা নেই। ধৈর্য হারিয়ে রীতিমতো রেগে গেলেন কনিষ্ক। শেষে দর্জিকে ধরে আনতে বলা হলো।

দর্জি কাপড়ের থানটি কনিষ্কের পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে হাতজোড় করে কাঁদো কাঁদো হয়ে জানালো, প্রাণ গেলেও সে একাজ করতে পারবে না। কনিষ্ক অবাক হয়ে এর কারণ জানতে চাইলেন। দর্জি জানালো, কাপড়ের এক জায়গায় মানুষের পা আঁকা আছে। আর কাপড়টি যেভাবে কেটেই পোষাক তৈরি করি না কেন, ওই পায়ের ছাপটি পিঠের ওপরেই পড়বে। তাই বহু চেষ্টা করেও পায়ের ছাপ বাদ দিয়ে সে পোষাক তৈরি করতে পারে নি। কনিষ্ক বুঝে গেলেন, কান‍্যকুব্জরাজ কৌশলে তাঁর পিঠে লাথি মারার ইঙ্গিত করেছেন! একথা ভেবে রাগে সারা শরীর কাঁপতে লাগলো তাঁর। দর্জিকে বিদেয় করে কান‍্যকুব্জ আক্রমণ করার উদ্যোগ নিলেন কনিষ্ক। সসৈন‍্যে কনিষ্কের যুদ্ধযাত্রায় রীতিমতো বিপদ মনে করলেন কান‍্যকুব্জরাজ। প্রজারা ভয়ে দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাতে লাগলো। এ অবস্থায় কান‍্যকুব্জরাজ বৃদ্ধ মন্ত্রীকে ডেকে উপায় বের করতে বললেন। প্রথমে মন্ত্রী কোনো কূলকিনারা পেলেন না। শেষে রাজার কাতর অনুরোধে বৃদ্ধ মন্ত্রী একটি উপায় বের করলেন। জানালেন, এখনি চণ্ডাল ডেকে মন্ত্রীর হাত ও নাক কাটতে হবে। এই নিষ্ঠুর কাজ করতে কিছুতেই রাজি হলেন না কান‍্যকুব্জরাজ। অবশেষে মন্ত্রীর বার বার অনুরোধে তাই করা হলো।

রাজাকে নমস্কার জানিয়ে অঙ্গহীন বৃদ্ধ মন্ত্রী দ্রুত কোথায় চলে গেলেন! কান‍্যকুব্জের সীমান্তে সৈন্য নিয়ে শিবির স্থাপন করেছেন কনিষ্ক। হাতির পিঠে চেপে বাইরে বেরোচ্ছিলেন তিনি। অঙ্গহীন মন্ত্রী হঠাৎ হাজির তাঁর সামনে। তখনও তাঁর কাটা জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। মন্ত্রী নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন, তিনি কান‍্যকুব্জরাজকে চিরদিনই কনিষ্কের বশীভূত থাকতে পরামর্শ দিয়ে এসেছেন। আর সেই রাগে তিনি তাঁকে এই শাস্তি দিয়েছেন। এখন তিনি চান, এর প্রতিশোধ নিতে। কনিষ্ক হেসে জানালেন, আর কয়েকদিন পরেই তিনি কান‍্যকুব্জ আক্রমণ করবেন। আর তখন কান‍্যকুব্জরাজের মৃত্যু নিশ্চিত। একথা বলে বৃদ্ধ মন্ত্রীর চিকিৎসার ব‍্যবস্থা করলেন কনিষ্ক। পরের দিন সকালে মন্ত্রী জানালেন, ভয়ে কান‍্যকুব্জরাজ পালিয়ে কোনো এক বন্ধুরাজার আশ্রয়ে পৌঁছতে চেষ্টা করছেন। সেখানে যাওয়ার পথ তাঁর জানা। কিন্তু সে খুব ভয়ংকর পথ। এক বিশাল মরুভূমি পেরিয়ে যেতে হবে। আর সৈন্যদের জন্য পনেরো দিনের পানীয় জল সঙ্গে নিয়ে বেরোতে হবে। তবেই কান‍্যকুব্জরাজকে বন্দি করা যাবে। তাতেই রাজি হয়ে গেলেন কনিষ্ক। পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন কান‍্যকুব্জের সেই মন্ত্রী। কিন্তু পনেরো দিনেই শেষ হয়ে গেল সবটুকু পানীয় জল। মরুভূমি তবুও শেষ হলো না। তৃষ্ণায় মৃতপ্রায় সৈন্যদল। জলের জন্য হাহাকার করতে লাগলো তারা।

রীতিমতো চিন্তিত কনিষ্ক। শেষে কান‍্যকুব্জের মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, এই পথের শেষ কোথায়? কান‍্যকুব্জের মন্ত্রী উত্তরে জানালেন, আমরা এখন মাঝ মরুভূমিতে এসে পৌঁছেছি। মৃত্যু অপেক্ষা করছে দুয়ারে। পানীয় জলের অভাবে মৃত্যু নিশ্চিত আমাদের সকলের। এরপর কান‍্যকুব্জের মন্ত্রী যা বললেন, তা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না কনিষ্ক। কান‍্যকুব্জের মন্ত্রী জানালেন, তিনি ইচ্ছে করেই কনিষ্কের সৈন্যদলকে এখানে টেনে এনেছেন। শুনে স্তম্ভিত কনিষ্ক! শেষে জানতে চাইলেন, তাঁর এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণ। কান‍্যকুব্জের মন্ত্রী জানালেন, নিজের দেশের রাজা ও রাজ‍্যকে রক্ষার জন্যই তিনি একাজ করেছেন। এভাবে কনিষ্কের সৈন‍্যদলকে মরুভূমিতে টেনে না আনলে এতদিনে কান‍্যকুব্জ ধ্বংস হয়ে যেতো। একথা শুনে কনিষ্ক তাঁর প্রভুভক্তির প্রশংসা করলেন এবং সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, তবুও কান‍্যকুব্জের মন্ত্রীর পরিকল্পনা সফল হবে না। দেবতার পুত্র কনিষ্কের গতিরোধ করা কারোরই সম্ভব নয়। বরং তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করতে বৃথা অঙ্গ ছেদনের জন্য এবার আফশোষ করতে হবে কান‍্যকুব্জের মন্ত্রীকে।

বলে ঘোড়ার পিঠে চেপে মরুভূমির বুকে জলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন কনিষ্ক। ঘুরতে ঘুরতে একটি জায়গায় খানিকটা নিচু জমি দেখতে পেলেন। কনিষ্ক সেখানে হাতের বর্শা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করলেন মাটিতে। সত্যিই জলের সন্ধান মিললো। আর এরপর কনিষ্ককে দেবপুত্র মনে করে সৈন্যরা তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগলো। তা দেখে বিষ্মিত কান‍্যকুব্জের মন্ত্রী। কনিষ্ককে জানালেন, ব‍্যর্থতার জন্য তাঁর আক্ষেপ নেই। কারণ, তিনি মানুষের শক্তিকে আটকাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দৈবশক্তির অধিকারি কনিষ্ককে পরাভূত করার শক্তি তাঁর নেই। এখন তিনি তাঁকে শাস্তি দিতে পারেন। তবে যেন কান‍্যকুব্জরাজকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, এটাই কনিষ্কের কাছে তাঁর শেষ প্রার্থনা।

কিন্তু ভাগ্যর হাতেই শাস্তি হলো কান‍্যকুব্জের রাজার। শোনা যায়, সম্রাট কনিষ্ক যেদিন জলের খোঁজে মরুভূমির বুকে বর্শা গেঁথেছিলেন, সেদিনেই হঠাৎ করেই কান‍্যকুব্জরাজের হাত-পা শরীর থেকে খসে পড়েছিল! কাহিনীটি রয়েছে আল্-বেরুণির লেখা "কিতাব-উল্-হিন্দ" গ্রন্থে।

তথ্যসূত্র: