কার্তিক সংক্রান্তিতে শুরু, অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে শেষ। একদিকে শস‍্যবৃদ্ধির কামনা এবং অন্যদিকে মোক্ষলাভের আশায় বাংলার মেয়েরা আয়োজন করে ইতুপুজোর।"মিত্র" থেকে "মিতু" এবং তা থেকে " ইতু।" আর "মিত্র" মানে সূর্য। অঘ্রাণে সূর্য গমন করে বৃশ্চিকরাশিতে। সূর্যের এই অবস্থানের নাম "মিত্র।" তাই ইতু মানেই সূর্যপুজো। মানুষ জেনেছিল, সকল শক্তির উৎস সূর্য। তাই এই সূর্যবন্দনা। গৃহস্থের গোবরে নিকোনো উঠোনে কিংবা তুলসীতলায় পাতা হয় ইতুর আটন। শিল-নোড়ায় আতপ চাল বেঁটে জলে গুলে আঙুলে কাপড় জড়িয়ে ইতুর আটনের চারপাশে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরণের আলপনা। আঁকা হয় মা লক্ষ্মীর চরণ। একটি মাটির মালসায় সাজানো হয় ধানের শিষ, অঙ্কুরিত পাঁচ কলাই, মান কচু, হলুদ, আখ, ধূপ, প্রদীপ, সিঁদুর, ফল, মিষ্টি, নবান্ন। ঘটের গলায় মালার মতো জড়ানো হয় পুকুর থেকে আনা দল-শ‍্যাওলা। সাত-সকালে বাড়ির গৃহিণী স্নান সেরে নদী বা পুকুর থেকে আনেন ইতুর ঘট। তারপর শুরু হয় পুরোহিতের হাতে ইতুপুজো।

"ইয়তি (ইতু) ইয়তি নারায়ণ

ড: সুকুমার সেনের মতে, প্রাচীন ইন্দ্রপুজো হচ্ছে এই ইতুপুজো। ঋগ্বেদের সুক্তগুলির নাম "ইন্দ্রস্তূপ", তা থেকে ইন্দথথু এবং সেখান থেকে "ইতু।" মেয়েরা ইন্দ্রের মতো বর লাভের বাসনায় ইন্দ্রা দ্বাদশীর দিন এই ইতুপুজো করে থাকে। তবে পুজোর উপকরণ দেখে ইতুকে শস্যপুজো বলেই জানা যায়। আসলে এই সময় গম, যব, সর্ষে প্রভৃতি রবিশস্যের চাষ হয়।

অবন্তীনগরে ছিল এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। অবশ্য সব গল্পেই ব্রাহ্মণ "দরিদ্র" এবং অন্যদিকে "বোকা তাঁতি", "বোকা চাষি"-র গল্প ছড়িয়ে আছে বাংলার লোকসাহিত্যে। যাই হোক্, দরিদ্র ব্রাহ্মণের পিঠে খাওয়ার ভীষণ ইচ্ছে। তাই ভিক্ষে করে জিনিসপত্র জোগাড় করে এনেছে। তারপর বামনীকে বলেছে, পিঠে তৈরি করে দিতে। সেই সঙ্গে হুকুম করেছে, মেয়েদের যেন একটাও না দেওয়া হয়। দুই মেয়ে উমনো আর ঝুমনো মনের দু: খে ঘুমিয়ে পড়েছে। এদিকে উনুনশালে বসে বামনী পিঠে তৈরি করছে। আর বামনীর ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে না পেরে বামুন পিঠে গুনে চলেছে। যতবার উনুনশাল থেকে ছ‍্যাঁক-ছোঁক্ আওয়াজ হয়, ততবার বামুন একটি দড়িতে গিঁট দেয়। এভাবেই পিঠে গুনে চলে বামুন। এদিকে বামনী একটি পিঠে ছিঁড়ে দুই মেয়ে উমনো-ঝুমনোকে দিয়ে দেয়। যতই হোক্, মায়ের মন তো!

এরপর খেতে বসে দেখে বামুন দেখে, গিঁট মিলছে না। একটি পিঠে কম। বামুনের ধমকে বামনী স্বীকার করে সত্যিটা।

একদিন দেশের রাজা ও মন্ত্রী শিকারে এলো। ঘুরতে ঘুরতে ভীষণ তেষ্টা পেল তাদের। জল চাইলো বামুনের ঘরে এসে। পরে তারা দুই বোনকে বিয়ে করতে চাইলো। সেইমতো উমনোর সঙ্গে রাজার এবং ঝুমনোর সঙ্গে মন্ত্রীর বিয়ে হলো।

ইতুর এই ব্রতকথার মধ্যে রয়েছে কিছু প্রাচীন প্রথা। যেমন, প্রাচীনকালে দড়িতে গিঁট দিয়ে গণনা করার প্রথা প্রচলিত ছিল। এ থেকেই শুরু হয়েছিল "কুইপান" বা "কুইপু" নামের গ্রন্থি লিপি। পেরু, পলেনেশিয়া ও প্রাচীন চিনে একসময় এই গ্রন্থি লিপি প্রচলিত ছিল। এছাড়াও মেয়েদের বনবাসে দেওয়া, গাছের কোটরে আশ্রয় নেওয়া এবং তারপর সমস্ত রকম প্রতিকূলতাকে জয় করে মেয়েদের বাড়ি ফেরা, এইসব লোককাহিনীর মধ্যে রয়েছে ইন্দো-ইওরোপীয় প্রভাব। তবে সবকিছুর মূলে ইতুপুজোয় রয়েছে বাংলার কৃষিভিত্তিক জীবনের ইঙ্গিত।