"গোরু মেরে জুতো দান" কিংবা "জুতিয়ে মুখ ভেঙে দেবো" বলার পরেও "পায়ের জুতো পায়েই থাকে।" কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে সাহেব অধ‍্যাপক ওটেন সাহেবের সামনে দিয়ে চটি ফটফটিয়ে যাওয়ার অপরাধে এক দেশি ছাত্রকে শাস্তি পেতে হয়। এর প্রতিবাদে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে সেখানে তুমুল আন্দোলন হয়েছিল। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের "জুতা আবিষ্কার" পড়ুয়ারা পড়েছেন। রামায়ণে ভরত অগ্রজ রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখেই তাঁর নামে অয‍্যোধ‍্যা শাসন করেছিলেন। এত কথা বলা হলো, তার মূলে জুতো। আজ জুতোর সাতকাহন। খ্রিস্টিয় একাদশ-দ্বাদশ শতকে বিদ‍্যালাভের জন্য প্রচুর পরিমাণে গৌড়ীয় বিদ‍্যার্থী কাশ্মীরে যেতেন। কাশ্মীরী কবি ক্ষেমেন্দ্র তাঁদের সম্পর্কে বলছেন, গৌড় বিদ‍্যার্থীরা পথ চলেন ধীরে ধীরে, মাঝে মাঝে তাঁদের উঁচু মাথা এদিক ওদিক দোলান এবং হাঁটার সময় তাঁদের ময়ূরপঙ্খী জুতোয় মচমচ শব্দ হয়।

ময়নামতি ও পাহাড়পুরের মাটির ফলক থেকে জানা যায়, যোদ্ধা, প্রহরীরা চামড়ার তৈরি পাদুকা ব‍্যবহার করতেন। তবে সে জুতোতে কোনো ফিতে ছিল না। শ্রাদ্ধে চামড়ার জুতো ও কাঠের খড়ম দানের রীতি ছিল, এখনো আছে। সাধু-সন্ন্যাসীরা অবশ্য কাঠের খড়ম ব‍্যবহার করতেন। জুতোর প্রাচীন নাম "কোশী।" এই "কোশী" পায়ে দিয়েই ক্ষত্রিয়রা ঘোড়ার পিঠে চেপে যুদ্ধে যেতেন। দেশের মধ্যে তাঁরাই ছিলেন সম্মানীয় নাগরিক। এই "নাগরিক" থেকে সংক্ষেপে এসেছে "নাগর" এবং নাগরিক বা নাগরদের জুতোর নাম হয়ে যায় নাগর-কোশী বা নাগরা জুতো। তবে তখনও কাঁচা চামড়াকে পাকা করার ট‍্যানিং প্রথা ছিল না। তখন কাঁচা গাবের আঠা দিয়ে চামড়াকে ভালো করে ঘষে নিয়ে রোদে শুকোনো হতো। তারপর কাঁচা জামের কষ বা বেলের আঠা দিয়ে হালকা গরমজলে ফুটিয়ে আবার তাকে রোদে শুকোনো হতো। শেষে আরেকবার গাবের আঠা ঘষে রোদে শুকোনোর পর সে চামড়া জুতো তৈরির উপযুক্ত হতো। তবুও সে চামড়ার কিছু গন্ধ থাকতো এবং সেজন্য ব্রাহ্মণ, বৈশ‍্য, শূদ্র এবং মেয়েরা জুতো ব‍্যবহার করতেন না। সৈনিকদের বুট জুতোর নাম ছিল "বৃহৎ কোশী।" এছাড়াও "জলকোশী" বলে আরেক ধরণের জুতোর ব‍্যবহার ছিল, যেটিকে স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, বর্ষার জুতো।

তখনও প্লাস্টিক যুগ আসে নি। চামড়ার ব‍্যাপক ব‍্যবহৃত ছিল এবং তখন জুতো তৈরিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল চর্মশিল্প। আজ প্লাস্টিকের বাজারে চ‍র্মশিল্পের নাভিশ্বাস উঠছে। প্রায় ১৫ হাজার বছর আগের স্পেনের প্রাচীন একটি গুহাচিত্রে মানুষের পায়ে চামড়া জড়ানো রয়েছে, দেখা যায়। খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয় ছিল কাঠের খড়ম। খ্রিস্টিয় ঊনিশ শতকে ফ্রান্সে কাঠ দিয়ে তৈরি হতো বিয়ের জুতো। তবে খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের আগে নারী-পুরুষের আলাদা জুতো ছিল না। মিশরের ফ‍্যারাওরা স‍্যাণ্ডেল পায়ে দিয়েই রাজকাজ চালাতেন। তবে সাধারণ মানুষের এ জুতো পরার অধিকার ছিল না। এমনকি, ইওরোপে রাণী এলিজাবেথের সময় আইন করে দেওয়া হয়, কেউ জুতো তৈরি করতে চাইলে তাকে ৫২/২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য-প্রস্থের জুতো তৈরি করতে হবে। এর বাইরের মাপের জুতো তৈরির অধিকার একমাত্র রাজপরিবারের আছে।

সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের সময়ে ফ্রান্সে তৈরি হয় হাইহিল জুতো। সাধারণ মানুষের এ জুতো পরার অধিকার ছিল না। এই হাইহিল জুতো নিয়ে ফ্রান্সে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয় এবং তাতে মারা যান বহু সাধারণ মানুষ। পরে লণ্ডনের কিছু ব‍্যবসায়ী হাইহিল জুতো তৈরি করেন। তবে প্রায় একশো বছর ধরে হাইহিল জুতো নিষিদ্ধ ছিল সাধারণ মানুষের কাছে। সব শেষে জুতোর প্রতি যৌন আসক্তির কথা। ফরাসি সাহিত্যিক নিকোলাই এঁদমে রেটিফ (২৩/১০/১৭৩৪-০২/০২/১৮০৬)-এর নাম অনুসারে এই জুতো বা পাদুকাসক্তির নাম "রেটিফবাদ।" এই তত্ত্বে মেয়েদের জুতো সেক্সি অর্থাৎ যৌনতাপূর্ণ হিসেবে বিক্রি হয়।

সমকামী পুরুষরা যৌন উত্তেজক হিসেবে এই ধ‍রণের জুতোর প্রতি আকৃষ্ট হোন। আর এর নাম "পাদুকাসক্তি।" এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সমকামী নারী-পুরুষরা জুতো চেটে পাদুকাসক্তির পরিচয় দিয়ে থাকেন। কথায় কথায় শত্রুকে জুতো চাটানোর কথা বলা হয় আমাদের দেশে। কিন্তু বিদেশে স্বেচ্ছায় এই জুতো চাটার তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। আশ্চর্য হলেও এটিও জুতোর সাতকাহনের অংশ।