আজকের দিনে টাকা-পয়সা ছাড়া যেন জীবন ফাঁকা।"অর্থ অনর্থের মূল" বলে যতই তত্ত্বকথা বলা হোক্ না কেন, অন্ন-বস্ত্র-আবাসের জন্য অপরিহার্য অর্থ। প্রাচীন ভারত থেকে আজকের দিনে টাকা-পয়সার বিবর্তন নিয়ে আজকের আলোচনা। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন ভারতে এক ধরণের রৌপ্য মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এর নাম ছিল "কার্ষাপণ।" ওজন ছিল ৩২ রতি। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে পশ্চিম ভারতে শক বংশোদ্ভূত রাজারা ৩২ রতির কম ওজনের রৌপ্য মুদ্রা চালু করেছিলেন। একেও "কার্ষাপণ" বলা হতো। আর সেজন্য খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীর লেখক বুদ্ধঘোষ "প্রাচীন" ও "নবীন" দু'রকম কার্ষাপণের উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি ৩২ রতির এবং দ্বিতীয়টির ওজন ছিল প্রায় ২৪ রতি।

পরবর্তীকালে গুপ্ত, ত্রৈকূটক, কলচুরিসহ বিভিন্ন বংশোদ্ভূত রাজারা শক মুদ্রার অনুকরণে রৌপ্য মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। এই মুদ্রা "রূপক" ও "দ্রম্ম" নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া এসব মুদ্রাকে "পুরাণ", "ধরণ" ও "কার্ষাপণ" নামেও ডাকা হতো।"কার্ষাপণ" পরবর্তীকালে হয়েছে "কাহন।" সংস্কৃত "টঙ্ক" বা "টঙ্কক" থেকে থেকে এসেছে হিন্দি শব্দ "টঙ্কা।" আর "টঙ্কা" থেকে "টাকা" শব্দটি এসেছে। ছেনি দিয়ে রূপোর পাত কেটে তৈরি হতো বলে রৌপ্য মুদ্রাকে "টঙ্কা" বলা হতো বলে গবেষকদের অভিমত। প্রাচীনকালে মধ‍্য ও পশ্চিম ভারতে প্রচলিত ছিল "বিংশোপক" নামে এক ধরণের তামার মুদ্রা। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুজরাট অঞ্চলের রাজা ছিলেন বিষ্ণুষেণ। তাঁর একখানি তাম্রশাসনে এই "বিংশোপক" মুদ্রার উল্লেখ দেখা যায় এবং এটি ছিল রৌপ্য মুদ্রা "রূপক"-এর এক-চতুর্থাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, ২০ বিংশোপক মানে ছিল ১ রূপকের সমান। অন্যদিকে, ঝান্সি জেলার সিয়াডোনীতে পাওয়া গুর্জর-প্রতিহার রাজাদের একটি শিলালিপিতে দেখা যাচ্ছে, ২০ বিংশোপক হচ্ছে ১ দ্রম্মের সমান। এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ, "রূপক" ও "দ্রম্ম" এ দুটি হচ্ছে একই রকম তামার মুদ্রার নাম।

গুজরাটের সোলাঙ্কি রাজবংশের লিপিতে "বিংশোপক" শব্দটি ব‍্যবহৃত হয়েছে ভূমির পরিমাণ বোঝাতে। অন্যদিকে আবার ওই অঞ্চলেই "বিংশোপক" তামার মুদ্রা "বীসোবা" নামে পরিচিত ছিল। সংস্কৃত "বিংশক" থেকে "বিংশোপক" এবং তা থেকে স্থানীয় ভাষায় "বীসোবা।" আবার মহারাষ্ট্রে ভূমির পরিমাণ বোঝাতে "বীসোবা" থেকে স্থানীয়ভাবে "বিসুবা" শব্দের ব‍্যবহার আছে। জমির মাপ "বিঘা"-র ২০ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এই "বিসুবা।"

মধ্য যুগে ভারতের রাজস্থান অঞ্চলে এক ধরণের তামার মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এর নাম ছিল "পাবীসা।" শব্দটির উৎস সংস্কৃত এবং সংস্কৃত ভাষায় এর মূল শব্দটি হচ্ছে "পাদ-বিংশক", যার অর্থ---বিংশকের (২০) এক-চতুর্থাংশ। এই হিসেবে ছিল, --- ৪ পাবিসা ১ বীসা মানে এক বিংশক বা বিংশোপক-এর সমান। আবার ৮০ পাবীসা ছিল এক রৌপ্য মুদ্রার সমান। এ প্রসঙ্গে পণ্ডিতদের অভিমত, "পাবীসা" থেকেই হয় মৌলিক শব্দ "পাইসা" এবং তা থেকে "পৈসা। আর "পৈসা" থেকে আজকের "পয়সা।" শব্দটি ইংরেজিতে আগে "Pysa", "Pyce" ইত্যাদি বানানে লেখা হতো, যদিও এটির ইংরেজি শব্দরূপটি হচ্ছে "Pice" বানানটি।

খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে মোগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল আল্লামী তাঁর "আইন-ই-আকবরী"-তে জানাচ্ছেন, ৪০ আকবরী মুদ্রা "দাম" ছিল ১ আকবরী "রূপিয়া"-র সমান। এই "দাম" পরিচিত ছিল "পৈসা" নামে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি এই পয়সার ওজন ১০০ গ্রেণ নির্দিষ্ট করে ৬৪ পয়সায় ১ টাকা স্থির করে। আরও পরে ১০০ পয়সায় ১ টাকা নির্দিষ্ট হয় এবং বর্তমানে এটিই চালু আছে।

তথ্যসূত্র: