পুরাণ অনুসারে, হিমালয় থেকে উৎসাহিত পূর্ব-দক্ষিণমুখী সাতটি প্রবাহের নাম "গঙ্গা।" এই সাতটির মধ্যে মাঝের প্রবাহটির নাম "ভাগীরথী।" সগররাজার মৃত ৬০ হাজার পুত্রদের উদ্ধারের জন্য এই বংশের উত্তরপুরুষ রাজা ভগীরথ স্বর্গ থেকে মর্ত্যভূমিতে গঙ্গা এনেছিলেন, এটাই বলা হচ্ছে পুরাণে। পুরাণে আরও বলা হচ্ছে, কুরু, ভরত, পাঞ্চাল, কৌশিক ও মগধ দেশ পেরিয়ে রাজমহল, সাঁওতালভূমি, চুটিয়া নাগপুর ( "ছোটনাগপুর" কথাটি ভুল), মালভূম, ধলভূম পাহাড়ের গোড়ায় প্রতিহত হয়ে উত্তর-রাঢ়, বঙ্গ ও তাম্রলিপ্ত দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতো ভাগীরথী। পুরাণ মতে, এই ভাগীরথীই হলো গঙ্গার প্রধান প্রবাহ। ম‍ৎস‍্য পুরাণ অনুসারে, উত্তর-রাঢ়দেশের ভেতর দিয়ে দক্ষিণবাহী এবং তার পূর্বে বঙ্গ, পশ্চিমে তাম্রলিপ্ত।

ভগীরথের গঙ্গা আনার কথা রামায়ণেও আছে এবং সেখানে গঙ্গা বলতে বোঝানো হয়েছে রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহকে। মহাভারতের যুধিষ্ঠির তীর্থস্নান করতে এসেছিলেন গঙ্গাসাগর-সঙ্গমে আর সেখান থেকে তিনি গিয়েছিলেন কলিঙ্গদেশে। তাই পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতের সাক্ষ‍্য অনুসারে বলা যায়, রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহ হলো আসল ভাগীরথী। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের আঁকা জাও-ডি-ব‍্যারোসের নকশা এবং ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের আঁকা ফান্-ড্রেক-ব্রোকের নকশায় পুরাণবর্ণিত ভাগীরথীর প্রাচীন পথের ইঙ্গিত রয়েছে। সুতরাং, বলা যায়, পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ওই দুটি নকশা। পুরাণে গঙ্গাস্নানে পুণ্যলাভের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পদ্মায় স্নানে সেসব কথা উল্লেখ নেই। গঙ্গা পুণ্যসলিলা, অন্যদিকে পদ্মা হচ্ছে কীর্তিনাশা। নদীতীরের বহু প্রাচীন কীর্তিকে ধ্বংস করেছে বলেই পদ্মার নাম হয়েছে "কীর্তিনাশা।"

বঙ্গ বা বাঙলার দক্ষিণ অংশকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয়েছে "সমতট।" পাহাড়-পর্বতহীন সমতল জায়গা বলেই নাম তার "সমতট।" বাঙলায় সমতটকে বলা হয় "বাগড়ি।" এই সমতটের রাজা ছিলেন সগর। এই সমতট অঞ্চলে সমান্তরালভাবে বহু নদী প্রবাহিত হয়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। বলা হয়, এগুলি আসলে কাটা খাল বা ক‍্যানেল। আরও বলা হয়, সবচেয়ে পশ্চিমে যে খালটি কাটা হয়েছিল, সেটির নাম ভাগীরথী। ভগীরথের কাটা খাল বলেই নাম ভাগীরথী। তাহলে বলতেই হয়, ভগীরথ ছিলেন সমতটের রাজা এবং তিনিই এই খালটি কাটিয়েছিলেন। তাই তার নাম "ভাগীরথী।" তারপর তার মাহাত্ম্য বাড়ানোর জন্য বলা হয়, ভাগীরথীর জলে স্নান করলে পুণ্যলাভের কথা বলা হয়েছে, যা পদ্মার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এর আরেকটি প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, মুর্শিদাবাদ জেলার কোনো কোনো জায়গায় ভাগীরথীকে বলা হয় "কাটিগঙ্গা।" গঙ্গা কেটে তৈরি বলেই নাম "কাটিগঙ্গা।"

"শয়ন-উত্থান-পাশমোড়া, তার মধ্যে ভীমে ছোঁড়া।

তাহলে বলতেই হবে, একজন বড়ো মাপের দক্ষ যন্ত্রবিদ্ ছিলেন সমতটের রাজা ভগীরথ। সগররাজার ৬০ হাজার পুত্র মারা গিয়েছিলেন, পুরাণের এই রূপক ভাঙলে দেখা যাবে, তাঁর রাজ‍্যে খরা দেখা দিয়েছিল এবং সেই খরা কাটাতে কৃষিতে জলসেচের জন্য খাল কেটে গঙ্গা-ভাগীরথীকে এনেছিলেন ভগীরথ। আর ভগীরথের কাটা খাল বলে গঙ্গার নাম হয়ে যায় "ভাগীরথী।" আধুনিক গবেষকরা কি বলেন? শুরু হোক্ নতুন করে গবেষণা।