বিদেশি বিধর্মী হানাদারদের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে অনেক পুঁথি, তবুও বাস্তবে বা বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে যা আছে, তাতেই এখনও "দ‍্য ওয়াণ্ডার দ‍্যাট্ ওয়াজ্ ইণ্ডিয়া।" মানুষের জীবনের ভিত তৈরি হয় শিক্ষায়, আরও বিশেষ করে বলা ভালো, সুশিক্ষায়। প্রাচীন ভারতের গুরুকুল শিক্ষা ছিল সত্যিকারের মানুষ তৈরির জায়গা। গুরুর বাড়িতেই ছিল এই আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্র। প্রাচীন ভারতের কাশ্মীর ছিল "সারদা স্থান।" মনু বলছেন, ---

তখন মুদ্রাযন্ত্র ছিল না, তাই বলে থেমে থাকেনি শিক্ষা। শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে পু়ঁথি নকল করে পড়াশুনো করতেন। শিক্ষার কোনও শর্টকাট পদ্ধতি ছিল না। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে রাজপুত্র---সবার জন্য ছিল কঠোর অনুশীলনের ব‍্যবস্থা। এমনকি, গুরু সন্দীপনি মুনির পাঠশালায় ছয় বেদাঙ্গ, উপনিষদ, চার বেদ, ধনুর্বেদ, তর্কশাস্ত্র ও ছয় প্রকার রাজনীতি বিদ‍্যা শিক্ষা করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। এই ছয় প্রকার রাজনীতি হচ্ছে---সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধ ও আশ্রয়। গুরুকুলের খরচ চালানোর জন্য বরাদ্দ ছিল রাজকীয় দান "অগ্রহার গ্রাম।" আর ব্রহ্মচারী বিদ‍্যার্থীদের ভিক্ষা দেওয়াটা ছিল গৃহস্থের কর্তব্য। ১০ হাজার বিদ‍্যার্থীকে যিনি খাওয়া-পরা ও বিদ‍্যাদান করতেন, তিনি ছিলেন "কুলপতি।" দুর্বাসা, কন্ব, শৌনক, যাজ্ঞবল্ক‍্যের মতো ঋষিরা ছিলেন "কুলপতি।" এই কুলপতিদের নিয়েই একেকটি আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠতো। হিন্দু মঠ-মন্দির-আশ্রমগুলি একেকটি শিক্ষাকেন্দ্র।

১) পূর্বজ্ঞান পরীক্ষার জন্য (আজকের ভাষায় "পূর্বপাঠের পুনরালোচনা"): উপক্রম,

রাজপুত্ররা যেহেতু ভবিষ্যতের "রাজা", তাই তাঁদের শিখতে হতো সাংখ্য, যোগ, লোকায়ত দর্শন, পুরাণ, ইতিহাস, আখ্যায়িকা, ধর্মশাস্ত্র, কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন, দণ্ডনীতি, যুদ্ধবিদ‍্যা, ১৮ রকম শিল্পকলা, গণিত, রসায়ন, জ‍্যোতিষ ও আয়ুর্বেদ। নালন্দায় ছিলেন প্রায় ১০ হাজার শিক্ষক-ছাত্র, বিক্রমশীলায় ৫ হাজার। শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। কৌটিল‍্যের লেখায় আমরা পাই ভারতের মৌর্যযুগের শিক্ষাব‍্যবস্থার পরিচয়। কৌটিল‍্য জানাচ্ছেন ( ১২ শ অধ‍্যায়), শিক্ষার মধ্যে ছিল শুশ্রূষা, শ্রবণম, ধারণম, উহপোহম, বিজ্ঞানম, তত্ত্বাভিনিবেশম।

১) শিক্ষার আগ্রহ ও উদ‍্যোগ: শুশ্রূষা,

ইৎ সিং আরও জানাচ্ছেন, ছয় বছর বয়সে ভর্তির ব‍্যবস্থা ছিল এবং আট বছর বয়সে পড়তে হতো পাণিনি ব‍্যাকরণের প্রথম অংশ। এরপর দশ বছর বয়সে পাণিনির কঠিন অংশ পড়তে হতো। তারপর পনেরো বছরে আয়ত্ত্ব করতে হতো গোটা পাণিনি ব‍্যাকরণ। সেই সঙ্গে পড়তে হতো পতঞ্জলির মহাভাষ‍্য, হেতুবিদ‍্যা ও অভিধর্ম। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ছিল নালন্দা। নালন্দায় ছিলেন অধ‍্যাপক অতীশ দীপঙ্কর, শান্ত রক্ষিত, পণ্ডিত শীলভদ্রের মতো বিশিষ্ট গুণীজনেরা।

তবে যাঁরা শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে শিক্ষার সুযোগ পেতেন না, তাঁদের জন্য ছিলেন সূত, চারণকবি, ভাটেদের মতো লোকশিল্পীরা। তাঁরা বিভিন্ন পুজো-পার্বণ, বিয়ে, উপনয়ন, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানে কথকতা গাইতেন। চারণকবিরা স্বদেশ প্রেম ও বিভিন্ন বীরদের কীর্তিকথা প্রচার করতেন। এ ছাড়াও জনসাধারণের লোকশিক্ষার জন্য ছিল যাত্রাপালা, পাঁচালী, কবিগান ও কথকতা। জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে মহাভারতের প্রচার করা হয়েছিল বলে জানা যায়।

ভর্তির পর শিক্ষার্থীকে নিতে হতো "উপাসক ব্রত" এবং এজন্য পঞ্চশীল নিয়ে ছিল জীব হত্যা, চুরি, মিথ্যা বলা, ব‍্যাভিচার ও মাদকদ্রব্য থেকে বিরত থাকার উপদেশ। সব মিলিয়ে এককথায় বলা যায়, প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব‍্যবস্থা ছিল এক পরিপূর্ণ জীবন গঠনের শিক্ষা এবং আজকের ছাত্র আন্দোলনে তখন বিষিয়ে যায় নি শিক্ষাঙ্গণগুলি। হিংসা বা রক্ত ঝরানো নয়, আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র শিক্ষা। তাই প্রাচীন ভারত ছিল সত্যিকারের বিস্ময়কর---"দ‍্য ওয়াণ্ডার দ‍্যাট্ ওয়াজ্ ইণ্ডিয়া।"