বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে প্রায় ১১৬ কিলোমিটার দক্ষিণে হিন্দু তীর্থ গয়া। মৃত ব‍্যক্তির আত্মার মুক্তির উদ্দেশ্য সারা বছর গয়ার ভিড় করেন মানুষজন। বিহার রাজ‍্যের ৩৯ টি জেলার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এই গয়ার আয়তন ৩০৮.৩১ বর্গ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১১১ মিটার। গয়া জেলাটি গঠিত হয় ইংরেজি ১৮৬৫ সালের ৩ রা অক্টোবর। গয়ার উল্লেখ রয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতে। রামায়ণ অনুসারে, পত্নী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে পিতা দশরথের পিণ্ড দিতে গয়ায় এসেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। অন্যদিকে, মহাভারতে গয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে "গয়াপুরী" হিসেবে। খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে শুরু করে খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসে এক অন্যতম সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতক নাগাদ সময়ে গয়া অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশুনাগ বংশ। পরবর্তীকালে বিম্বিসারের আমলে বাইরের জগতের সঙ্গে গয়ার পরিচিতি ঘটে। বিম্বিসারের সময় জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর ও বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ গয়ায় এসেছেন।

কিছুদিন নন্দ রাজাদের অধীনেও ছিল এই গয়া। পরে সম্রাট অশোকের আমলে গয়া মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বুদ্ধদেবের বোধিলাভের স্থান বুদ্ধগয়ায় অশোক প্রথম মন্দির তৈরি করিয়ে দেন। পরবর্তীতে গুপ্ত আমল ছিল হিন্দু পুনর্জাগরণের যুগ। প্রধান প্রধান পুরাণগুলি এই গুপ্তযুগেই রচিত হয়। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সময় গয়া নতুন করে প্রচারের আলোয় আসে। গুপ্ত আমলে গয়া বিহার প্রদেশের প্রধান শহরে পরিণত হয়। বাংলায় পাল বংশের আমলে গয়া এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং বুদ্ধগয়ার বর্তমান মন্দিরটি পালরাজ ধর্মপালের তৈরি বলে জানা যায়। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কি সৈনাধ‍্যক্ষ বখতিয়ার খিলজি গয়ায় লুঠপাট চালান। তবে পরবর্তীতে গয়ার হিন্দু শাসকরা উচ্ছেদ করেছিলেন বখতিয়ারের তুর্কি সেনাপতিদের। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। গয়ার বৃত্তান্ত রয়েছে বায়ুপুরাণে। সেখানে বলা হচ্ছে, গয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে গয়াসুরের নাম থেকে। পিতা ত্রিপুরাসুর ও মা প্রভাবতীর পুত্র গয়াসুর বিষ্ণুর বর লাভের জন্য কোলাহল পর্বতে শুরু করলেন কঠোর তপস্যা।

ইতিপূর্বে দেবতাদের হাতে নিহত হয়েছেন গয়াসুরের পিতা ত্রিপুরাসুর। তাই বর লাভের পর প্রতিশোধ নিতে চায় গয়া, তাহলে দেবতাদের অবস্থা হবে শোচনীয়। তাই গয়া যাতে তার কাঙ্ক্ষিত বর না পায়, সেজন্য দেবতারা আগেভাগেই হাজির হলেন বিষ্ণুর কাছে। বললেন সব বুঝিয়ে। গয়া চাইলেন, তাঁকে ছুঁয়েই যেন জীবকুল যায় বৈকুন্ঠে। রাজি হলেন বিষ্ণু। এরপর বিষ্ণু একটি যজ্ঞের আয়োজন করতে বললেন ব্রহ্মাকে। এজন্য দরকার একটি পবিত্র দেহ। আর বিষ্ণুর বরে তখন পবিত্র হয়েছে গয়ার দেহ। ব্রহ্মা জগতের কল‍্যাণের জন্য গয়ার দেহ চাইলেন। রাজি হলেন গয়া। এবার যোগবলে নিজের দেহ বিস্তৃত করলেন গয়া। কোলাহল পর্বতে থাকলো তার মাথা, নাভিদেশ বাজপুরে এবং চন্দ্রভাগায় পা। তারপর পাষাণে পরিণত হলো গয়ার দেহ। ভগবান বিষ্ণু এরপর তাঁর পা দু'খানা রাখলেন গয়ার মাথায় এবং সেই সঙ্গে ঘোষণা করলেন, গয়ায় এই বিষ্ণুর পদপ্রান্তে পিণ্ড দান করলে স্বর্গলাভ হবে মৃত আত্মার। গয়াসুরের নাম নিয়ে গয়া পরিণত হলো পিণ্ডদান ক্ষেত্রে। গয়ার চারদিকে রয়েছে পাহাড়, পূর্বে অন্ত: সলিলা ফল্গুনদী, উত্তরে রামশিলা, দক্ষিণে ব্রহ্মযোনি এবং পশ্চিমে প্রেতশিলা।

গয়ার ব্রহ্মযোনি পাহাড় হলো সবচেয়ে উঁচু। এই পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি তৈরি করিয়ে দিয়েছেন ইন্দোরের রাণী অহল‍্যাবাঈ।

গয়ায় রয়েছে মৃত আত্মাদের উদ্দেশ্যে হিন্দুদের পিণ্ডদান ক্ষেত্র বিষ্ণুপাদ মন্দির। খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকে তৈরি এই মন্দিরেই হয় পিণ্ডদানের কাজ। এছাড়া রয়েছে গয়া থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরে বারাবার পাহাড়ে বারাবার গুহা।