একসময় আমাদের দেশে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও বিভিন্ন দেশীয় ভাষা একইরকম অক্ষর বা লিপিতেই লেখা হতো। তবে দেশকাল ভেদে এই লিপির আলাদা আলাদা রূপ ছিল। আজকের দিনে যেমন সংস্কৃত লেখা হয় নাগরী অর্থাৎ দেবনাগরী লিপিতে, প্রাচীনকালে কিন্তু তা ছিল না। শুধুমাত্র সংস্কৃত লেখার জন্য আলাদা কোনো লিপির ব‍্যবহার ছিল না, সব ভাষার জন্য ছিল একই ধরণের লিপি।

তাই দেবনাগরী বা নাগরী লিপি প্রাচীন নয়, বরং নাগরী লিপির চেয়েও বাংলা লিপি অনেক বেশি প্রাচীন। বর্তমানে বাংলা লিপি বলতে যা বোঝায়, তা হলো শ্রীহর্ষ লিপি। স্থানীশ্বররাজ (থানেশ্বর) হর্ষবর্ধনের স্বাক্ষরে পাওয়া গেছে যে বাংলা লিপি, সেটাই শ্রীহর্ষ লিপি। তবে হর্ষবর্ধনের আগে থেকেই এই লিপি প্রচলিত ছিল। এই শ্রীহর্ষ লিপির বর্তমান বাংলা রূপটি প্রায় ১২০০ বছরের পুরোনো। বাঁকুড়া শহরের কাছে ছাতনা থানার শুশুনিয়া পাহাড়ে রাজা চন্দ্রবর্মার দানপত্রের যে লিপি পাওয়া গেছে, সেই প্রাচীন বাংলা লিপির সঙ্গে শ্রীহর্ষ লিপির যথেষ্ট মিল রয়েছে। লিপির ভাব ও ভাষা দেখে বলা যায়, বাংলায় তখন পৌরাণিক ধর্ম বা ব্রাহ্মণ‍্যধর্ম প্রচলিত ছিল। সুতরাং, এই লিপিটি খোদিত হয়েছিল গুপ্তযুগ কিংবা তার পরে।

পূর্ব ভারতে প্রচলিত এই ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকেই উৎপত্তি হয় বাংলা বর্ণমালার। গুপ্তযুগের আগে পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানে যেসব লিপি বা বর্ণমালা প্রচলিত ছিল, তাদের মধ্যে বিশেষ তফাৎ ছিল না। রুচি অনুয়ায়ী লিপি কিছুটা পাল্টালেও এক জায়গার মানুষ অন্য জায়গার লেখা পড়তে পারতো। প্রাদেশিক বর্ণমালার মধ্যে প্রভেদ বেড়ে যায় গুপ্তযুগেই। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের বর্ণমালা দুটি পৃথক পদ্ধতি অবলম্বন করে। পশ্চিম ভারতের সিন্ধু উপত্যকার বর্ণমালা ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হয় নাগরী লিপিতে এবং অন্যদিকে, পূর্ব ভারতে প্রচলিত ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকে উৎপত্তি হয় বাংলা লিপির।

পূর্ব ভারতে প্রচলিত এই বর্ণমালার নিদর্শন দেখা যায় সমাচারদেবের কোটালীপাড়া তাম্রশাসনে। এরপর খ্রিস্টিয় সপ্তম থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত এই লিপির অনেক পরিবর্তন ঘটে। এর ওপর প্রভাব ফেলে খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দীতে প্রচলিত পশ্চিম ভারতের বর্ণমালা। তবে ওই শতাব্দীর শেষভাগে পালরাজা প্রথম মহীপালের সময়ে এই প্রভাব দূর হয় এবং বাংলা বর্ণমালার পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যায় পূর্ব ভারতে প্রচলিত বর্ণমালার মধ্যে। প্রথম মহীপালের বাণগড় লিপিতে ব‍্যবহৃত অ, উ, ক, খ, গ, ধ, ন, ম, ল এবং ক্ষ অক্ষরগুলি অনেকটাই বাংলা অক্ষরের কাছাকাছি। এছাড়া "জ" অক্ষরটি পুরোপুরি বাংলা বর্ণের মতোই। আবার খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীতে সেনরাজ বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে ব‍্যবহৃত বর্ণমালার মধ্যে ২২ টি বর্ণ পুরোপুরি বাংলা বর্ণমালার মতোই।

সিংভূম জেলার পটমদা থানার ভুলা-পাবনপুর গ্রাম ও তার পাশে কমলপুর থানার বাঙ্গুরদা গ্রাম এবং তার দক্ষিণ-পশ্চিমে চাণ্ডিল থানার জায়দা গ্রামে জৈনযুগের বেশকিছু নিদর্শনের সঙ্গে পাওয়া গেছে প্রায় সতেরোশো বছরের বেশি পুরোনো বাংলা লিপির নিদর্শন। এই লিপি শুশুনিয়া লিপি ও শ্রীহর্ষ লিপির চেয়েও প্রাচীন। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকের তাম্রশাসনে উৎকীর্ণ অক্ষরগুলি প্রায় বর্তমান বাংলা লিপির অনুরূপ।

এর পরবর্তী তিনশো থেকে চারশো বছরে স্বাভাবিকভাবেই বাংলা বর্ণমালার কিছু বদল ঘটে। তবে খ্রিস্টিয় সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা বর্ণমালার কিছু পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গুপ্তযুগের পর বাংলায় যখন স্বাধীন শক্তিশালী রাজ‍্য তৈরি হয়, তখন থেকেই পূর্ব ভারতে একটি বিশেষ বর্ণমালার প্রচলন হয় এবং কালক্রমে সেই বর্ণমালার বিবর্তন ঘটে তৈরি হয় বাংলার নিজস্ব বর্ণমালা। এখানে বলা দরকার, সংস্কৃত, প্রাকৃত ও বিভিন্ন দেশীয় ভাষা বাংলার প্রচলিত অক্ষরেই লেখা হয়েছে চিরকাল। সংস্কৃত ভাষার জন্য নাগরী লিপির ব‍্যবহার অপেক্ষাকৃত আধুনিক। নাগরী লিপির চেয়ে বাংলা লিপি অনেক প্রাচীন। তাই প্রাচীন বাংলায় সংস্কৃত ভাষায় লেখা সমস্ত তাম্রশাসন ও পুঁথি লেখা হয়েছে সে সময়ে প্রচলিত বাংলা লিপিতেই। খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দীর প্রচলিত বাংলা ভাষায় লেখা চর্যাপদগুলি হলো বাংলা সাহিত্যের আদিম উৎস। পরবর্তীকালে এই চর্যাপদের প্রভাবেই সৃষ্টি হয়েছে সহজিয়া গান, বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলী এবং বাউল গান।

এ পর্যন্ত ২২ জন কবির লেখা ৪৭ টি চর্যাগান পাওয়া গেছে। তবে চর্যাপদ ছাড়াও সে সময় প্রাচীন বাংলা ভাষায় লেখা অন্যান্য শ্রেণির সাহিত্য ছিল। চালুক‍্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের সময়ে (১১২৭-১১৩৮ খ্রি: ) রচিত "মানসোল্লাস" গ্রন্থটি তার উদাহরণ। এই গ্রন্থের "গীত-বিনোদ" অধ‍্যায়ে বিভিন্ন দেশীয় ভাষায় লেখা গানের উল্লেখ আছে, যার মধ্যে রয়েছে বিষ্ণুর অবতার ও গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা বিষয়ক কয়েকটি বাংলা গানের অংশ। ওই সময় বাংলা ও বাংলার বাইরে সাহিত্যের বহুল প্রচলিত ভাষা ছিল শৌরসেনী অপভ্রংশ। অনেক কবি বাংলা ও শৌরসেনী অপভ্রংশ---একসঙ্গে দুটি ভাষাতেও কবিতা লিখেছেন। একসময় আর্যাবর্তের পূর্বভাগে সাধু ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল এই শৌরসেনী অপভ্রংশ। পরবর্তীকালে তার দখল করে নেয় বাংলা ভাষা।

খ্রিস্টিয় নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চারশো বছর সময়কাল ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদিম যুগ। পরবর্তীকালে রচিত কবি জয়দেবের "গীতগোবিন্দ" কাব্যের রচনাশৈলী প্রাচীন বাংলা ভাষা ও অপভ্রংশে লেখা গীতি কবিতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। খ্রিস্টিয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে বাংলা অক্ষরগুলি একটি নির্দিষ্ট রূপ পায়, যা আজও প্রচলিত রয়েছে।