সময়কাল: ১৭০১ খ্রিস্টাব্দ। মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে দাক্ষিণাত‍্যে মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজির তখন ঘোরতর লড়াই চলছে। মোগল বাহিনী কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না মারাঠাদের। পার্বত্য উপজাতিদের নিয়ে তৈরি শিবাজির দুর্ধর্ষ মাওয়ালি সেনা এবং শিবাজির গেরিলা নীতি বার বার মোগলদের সব আক্রমণ ব‍্যর্থ করে দিচ্ছে। যুদ্ধে জয় তো হচ্ছেই না, অথচ মোগল রাজকোষ থেকে খরচ হয়ে যাচ্ছে গোরুর গাড়ি বোঝাই কাঁড়ি কাঁড়ি রুপোর টাকা। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্য। দিল্লিতে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। বাংলার নবাব তখন আজিম-উস-শান। আর দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান। নবাবের সঙ্গে দেওয়ানের দিনরাত ঝগড়া চলতো। এ নিয়ে ঔরঙ্গজেবের কাছে দু’ জনেই দু’ জনের বিরুদ্ধে নালিশ করতেন। মুর্শিদকুলির দেওয়ানি দপ্তরখানা ছিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায়। শেষ পর্যন্ত দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান তাঁর দেওয়ানি দপ্তর ঢাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন মুকশুদাবাদে।

পরবর্তীকালে মুর্শিদকুলির নাম থেকেই মুকশুদাবাদের নাম হয় আজকের মুর্শিদাবাদ। দেওয়ান মুর্শিদকুলি দেশের রূপোর টাকাকে গোরুর গাড়ি বোঝাই করে পাঠাতে লাগলেন দাক্ষিণাত‍্যে যুদ্ধের খরচ হিসেবে। এর ফলে বাংলায় আর টাকা থাকলোই না। অগত্যা কড়ি দিয়ে শুরু হলো লেনদেন। তখন থেকেই উদ্ভব হলো “টাকাকড়ি” শব্দটির। টাকা নেই বলে কড়ি দিয়ে লেনদেন চালানো হতো। কিন্তু বড়ো বড়ো কারবারে কড়ি দিয়ে কাজ চালানো যাচ্ছিল না। ওদিকে দক্ষিণ ভারতে মাদ্রাজের কাছে (অধুনা চেন্নাই ) আর্কট নামে একটি জায়গায় ইংরেজরা তাদের ব‍্যবসায়িক লেনদেনের জন্য একটি টাকা তৈরির টাঁকশাল বসিয়েছিল। কখনও নিজেদের দেশ, কিংবা কখনও চিন থেকে রূপোর চাঙ আনিয়ে তা দিয়ে সেখানে টাকা ছাপা হতো। স্থাননাম অনুসারে সে টাকার নাম ছিল “আর্কট টাকা।” দিল্লির বাদশার নামেই ছাপা হতো সে টাকা। ঔরঙ্গজেব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন বাজারে বেশ চালু ছিল এই আর্কট টাকা। কিন্তু ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে শিবাজির সঙ্গে যুদ্ধক্লান্ত ঔরঙ্গজেব “দাক্ষিণাত‍্য ক্ষত” নিয়েই মারা গেলেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ভারতে ইংরেজদের তৈরি আর্কট টাকা অচল হয়ে গেল। এদেশে তখন চালু হয়েছে সিক্কা টাকা। আর্কট টাকা দিয়ে সিক্কা টাকা নিতে গেলে অনেকখানি বাটা দিতে হতো। এর ফলে ইংরেজদের ব‍্যবসায়ে ক্ষতি হতে লাগলো প্রচুর। অনেক পরে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে জিতে ইংরেজরা সেই ক্ষতি সুদে-আসলে উশুল করে নিয়েছিল। তবে মুসলমান আমলের থেকে অমুসলমানদের কাছে ইংরেজ আমলে কষ্টের পরিমাণ কম ছিল। কারণ, এক আকবরের আমল ছাড়া অন্য নবাব-বাদশার আমলে হিন্দুরা ছিল ক্রীতদাসের সামিল দ্বিপদ জীব মাত্র।

এই সময় হিন্দুদের কোনো সামাজিক মর্যাদাই ছিল না। তখন বাধ‍্য হয়ে হিন্দুরা নিজেদের সমাজে ছ‍্যুঁৎ মার্গ চালু করে নন্ কো-অপারেশনের পথ ধরলো। লোকসংখ্যা কম ছিল বলে মুসলমান আমলে খাবারের খানিকটা সুখ ছিল। তবে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল বলে লোকক্ষয় হতো। আর তার পিছু পিছু আসতো দুর্ভিক্ষ মহামারী। এর কোনোটাই প্রজাবৃদ্ধির সহায়ক ছিল না। মুসলমান আমলে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই থাকতো বলে চাষিদের খামারে সব শস্য আসতো না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজকর্মচারি আর সৈন্যবাহিনীর লোকজন কেড়ে নিয়ে যেতো। এর ফলে দেশের ভেতরে না ছিল কোনো শান্তি, না ছিল সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা। সব মিলিয়ে মুসলমান আমলের সেসব সময় ছিল সাধারণ মানুষের কাছে দু: স্বপ্নের কালরাত্রি। ইংরেজ আমলে অমুসলমানদের ওপর থেকে “কাফের”, “জিম্মি”, জিজিয়ার মতো অপমানজনক শব্দগুলো উঠে গিয়েছিল।