তিনি জ‍্যোতিষগুরু, তিনি বরাহমিহির। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দশক থেকে শুরু করে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দশকের মানুষ। তাঁকে ঘিরে রয়েছে নানান কাহিনী। মহাকবি কালিদাসের লেখায় তিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন। আবার লোককথায় তিনি নারী জ‍্যোতিষী খনার শ্বশুর। কারো লেখায় তিনি শুধুই "বরাহ", কারো লেখায় তিনি আবার "মিহির" নামে পরিচিত। আবার কারো কাছে দুইয়ে মিলে তিনি "বরাহমিহির।" "বৃহজ্জাতক" অনুযায়ী বরাহমিহির অবন্তীনগর অর্থাৎ উজ্জ্বয়িনীর মানুষ। আবার "ভবিষ্য পুরাণ" অনুসারে দেখা যাচ্ছে, কাঞ্চির রাজকুমার পূষণ মৃত্যুর পর সূর্যদেবের কাছে যান। সেখানে তিনি সূর্যের অবতার হিসেবে মিহিরাচার্য নাম নিয়ে উজ্জ্বয়িনী নগরীতে রুদ্রপশুর ঘরে জন্ম নেবেন বলে বর লাভ করেন। তারপর অশুভ মুহূর্তে জন্মেছেন বলে মা-বাবা তাঁকে ভাসিয়ে দেন সমুদ্রের জলে। ভাসতে ভাসতে পৌঁছেন লংকায়। সেখানে রাক্ষসীর দল তাঁকে জল থেকে তোলে। তাদের কাছেই বড়ো হোন মিহির। তাদের কাছেই জ‍্যোতিষ বিদ‍্যা শেখেন তিনি।

এরপর লংকার শাসক বিভীষণ তাঁকে উজ্জ্বয়িনীতে ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। এই উজ্জ্বয়িনীতে মিহির হোন জ‍্যোতিষ গুরু মিহিরাচার্য। বরাহমিহিরের সম্পর্কে আরেকটি কাহিনী পাওয়া যায় জৈন কাহিনীতে। সেখানে বলা হচ্ছে, তাঁর জন্ম পাটলিপুত্রে এক গরীব পরিবারে। তাঁর ভাই ভদ্রবাহু ছিলেন একজন জৈন ধর্মগুরু। ছোটবেলায় মিহির গোরু চরাতেন আর এর ফাঁকে চলছিল তাঁর জ‍্যোতিষ চর্চা। একবার মিহির গোরু চরানোর অবসরে একটি পাথরের ওপর জন্মকোষ্ঠী এঁকে ফেলেন। ভুলে না মুছেই তিনি ঘরে ফেরেন। রাতে হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেকথা। রাতেই চলে আসেন সেই কোষ্ঠীর কাছে। এসে দেখেন এক অবাক করা দৃশ্য, এক সিংহ সেই কোষ্ঠী পাহারা দিচ্ছে। দুরন্ত সাহসে ভর করে সিংহের সামনেই মিহির মুছে ফেলেন তাঁর আঁকা কোষ্ঠী।

এরপর আরও এক বিষ্ময় অপেক্ষা করেছিল তাঁর জন্য। সিংহ ছদ্মবেশ ছেড়ে সামনে দাঁড়ালেন স্বয়ং সূর্যদেব। জ‍্যোতিষ চর্চায় আগ্রহী মিহিরকে সূর্যদেব আকাশের সবক'টি গ্রহ-নক্ষত্রকে চিনিয়ে দিলেন। সূর্যদেবের বরে উত্তরকালে মিহির হোন রাজজ‍্যোতিষী। আবার গুজরাটি লোককথায় বরাহমিহিরকে নিয়ে রয়েছে অন্য এক কাহিনী। সেখানে সূর্যের বরে অপুত্রক দম্পতি আদিত্যদাস ও ইন্দুমতীর পুত্র হিসেবে মিহিরের জন্ম। যৌবনে তাঁর জ‍্যোতিষবিদ‍্যার খবরে রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় ঠাঁই হয়। সেখানে রাজকুমারের কোষ্ঠী বিচার করে মিহির জানালেন, আঠারো বছর বয়সে এক বিশেষ দিনে বরাহের আক্রমণে মৃত্যু হবে রাজকুমারের, এটাই তাঁর ললাট লিখন। শুনে রীতিমতো রেগে গেলেন রাজা বিক্রমাদিত্য। কিন্তু মিহির নির্বিকার। বয়স আঠারো হলে ওই বিশেষ দিনটিতে রাজকুমারকে রাখা হলো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। তবুও যথাসময়ে ফলে গেল মিহিরের ভবিষ্যৎ বাণী।

মৃত্যু হলো রাজকুমারের। শোকাহত পিতা তথা রাজা বিক্রমাদিত্য এরপর মিহিরের অভ্রান্ত জ‍্যোতিষ গণনায় খুশি হয়ে তাঁকে দিলেন বরাহের প্রতীক। এরপর থেকে মিহির হলেন "বরাহমিহির।" পরবর্তীকালে বরাহমিহির লেখেন জ‍্যোতিষের ওপর তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ---পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, বৃহজ্জাতক বা বৃহৎ সংহিতা। এবার আসি বরাহমিহিরের লেখায় গুপ্তযুগের ভারতবর্ষ সম্পর্কে। বরাহমিহিরের লেখায় বাল‍্যবিবাহের উল্লেখ নেই। তিনি তাঁর "বৃহৎ সংহিতা"-য় কন‍্যালক্ষণাধ‍্যায় বিভাগে কুমারী ও বিবাহযোগ‍্যা নারীর যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা বাল‍্যবিবাহের বিপরীত। বরাহমিহিরের লেখায় ইঙ্গিত রয়েছে, স্বামীর সঙ্গে সুখকর সহবাসের জন্য যে শারীরিক ও মানসিক গঠনের দরকার, তার জন্য নারীকে সাবালিকা হতে হবে। তাই বলা যায়, যে গুপ্তযুগ ছিল ভারত ইতিহাসের সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ, সেই যুগে বাল‍্যবিবাহ স্বাভাবিক নিয়ম ছিল না।

বরাহমিহির আরও লিখেছেন, কখনও কখনও অসবর্ণ বিয়ে হতো ঠিকই, তবে তা সামাজিকভাবে পছন্দের ছিল না। আর পুরুষের জীবনে অপরিহার্য ছিলেন স্ত্রী, আক্ষরিক অর্থেই আজকের ভাষায় "অর্ধেক আকাশ।" এমনকি, সহধর্মিণী সঙ্গে না থাকলে স্বামীর দান-ধ‍্যান থেকে সব কাজ ছিল অসিদ্ধ। তবে স্বামীর মন জয় করার কিছু টিপস দিয়েছেন বরাহমিহির। তিনি বলেছেন, নারীর গুণ হলো তার যৌবন, সৌন্দর্য, সাজগোজ, শিষ্টাচার ও শিল্পজ্ঞান‌। আর এসব গুণ থাকলে তবেই তিনি হবেন যোগ্যা সহধর্মিণী। শুধু তাই নয়, দম্পতির সংসার-সুখ ঠিকঠাক রাখতে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন বরাহমিহির। যেমন, সন্ন্যাসীনী, দাসী, অবিবাহিতা নারী, মালিনী, ধোপানি, নাপিতানিদের থেকে দূরে রাখতে হবে স্ত্রীদের। কারণ, এরা একের কথা অন্যের কানে দিয়ে গৃহশান্তি নষ্ট করে। এছাড়াও রাতের বেলায় বেড়ানো, আত্মীয় বাড়িতে রাত কাটানো, সাধু সংসর্গ, অনেকজন মিলে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠান থেকে স্বামী তার স্ত্রীকে আগলে রাখবেন। কারণ, এতে পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশা হয়, যা বরাহমিহিরের চোখে বিপজ্জনক।

সমাজে মদ‍্যপান প্রচলিত থাকলেও বরাহমিহির তা পছন্দ করতেন না। তার প্রমাণ তাঁর লেখায়, যেখানে তিনি বলছেন, মাতাল হারিয়ে ফেলে তার বোধবুদ্ধি। মাকে মনে করে স্ত্রী, আর স্ত্রীকে মনে করে মা। খাদ‍্য-অখাদ্যের প্রভেদ বোঝে না। ঘর তার কাছে মাটির ঢিবি, কুয়ো হলো তার কাছে থাকার জায়গা। ডোবা তার কাছে সমুদ্র, আর সমুদ্রকে মনে করে সমতলভূমি। মাতাল নিজেকে রাজার বন্ধু মনে করে। বরাহমিহির পুত্রকন্যার জন্ম বিষয়েও কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যৌনসংসর্গের সময় পুরুষের শুক্রাণু আর মেয়েদের রক্তের ওপর নির্ভর করে পুত্রকন্যার জন্ম। তাঁর মতে, পুরুষের শুক্রাণুর পরিমাণ বেশি হলে জন্ম হবে পুত্রের, তা না হলে কন্যা সন্তান হবে। তাই পুত্রলাভে ইচ্ছুক স্বামীকে শুক্রাণুর পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন তিনি এবং এর জন্য কিছু খাদ্যের কথাও বলেছেন। সব মিলিয়ে ভারতীয় জ‍্যোতিষ-গুরুর পাশাপাশি বরাহমিহির এক আশ্চর্য জীবন দর্শনের নাম।

তথ্যসূত্র: