মেয়েদের যেমন ধর্ষণ করা হয়েছে, ছেলেদের তেমনি খোজা করে সারা জীবনের জন্য তাকে পুরুষত্বহীন নপুংসক করে দেওয়া হয়েছে। দুটোই অমানবিক। তবুও বিভিন্ন সময়ে শাসকের মদতে ঘটেছে এই নিষ্ঠুর ঘটনা। আজকের লেখায় খোজা পুরুষের খোঁজ-খবর।"খোজা" শব্দটি উর্দু, পুরো কথাটি হলো---"খোজা সারাহ।" সুতরাং, এটি ভারতীয় প্রথা নয়। প্রাচীন ভারতে হিজড়াদের কাজে লাগানো হয়েছে, কিন্তু কোনো ছেলেকে খোজা করা হয়নি।

গ্রীক ভাষায় খোজাকে বলা হয় "ইউনাক" ( Eunuch), যা এসেছে "Eunoukhos" থেকে, যার মানে "শোবার ঘর পাহারাদার।" Eune মানে---বিছানা আর Ekhein মানে---পাহারা দেওয়া। ল‍্যাটিন ভাষায় খোজাকে বলা হয় "স্প‍্যাডো" ও "ক‍্যাস্ট্রাটাস।" কৃত্রিমভাবে ছেলেদের কখনো শুধুমাত্র শুক্রাশয়, আবার কখনো শুক্রাশয় ও শিশ্ন---দুটোই কেটে বাদ দেওয়া হতো। এরপর ক্ষত সারাতে ব‍্যবহার করা হতো মরুভূমির বালি। এজন্য অনেক সময় ক্ষত না সারা পর্যন্ত তাদের গলা অবধি মরুভূমির বালিতে পুঁতে রাখা হতো। সাধারণত বয়: সন্ধির আগেই বালকদের খোজা করা হতো আর সেজন্য তাদের যৌন চাহিদাও থাকতো না। এছাড়া বন্দি বালকদের খোজা করা হতো।

মধ্য প্রাচ‍্য ও চিনে খোজা প্রথা ছিল। খ্রিস্ট পূর্ব একুশ শতকে সুমেরিয় শহর লাগাসে এ ধরণের খোজা করার কথা জানা যায়। প্রাচীন চিনে ষোলোশো খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে পরবর্তী কয়েক বছর ধরে এই খোজা প্রথা চালু ছিল। ওই সময়কালে চিন সম্রাটের অধীনে ছিল প্রায় ৭০ হাজার খোজা। প্রাচীন গ্রীস ও রোমেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিশরে বন্দি পুরুষদের খোজা করে পাঠানো হতো ফ‍্যারাওদের কাছে। মিশরের মহিলা মহলেও খোজারা পাহারায় থাকতো। অটোমান তুর্কিদের সময়ে কালো চামড়ার খোজাদের চাহিদা ছিল বেশি। এদের বলা হতো "চিফ ব্ল‍্যাক ইউনাখ।" অটোমান তুর্কিরা কোনো খ্রিস্টান দেশ জয় করার সময় সেখান থেকে খোজা নিয়ে আসতো। মিশর, আবিসিনিয়া ও সুদান প্রভৃতি দেশ থেকে খোজারা আসতো। ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছিল হারেম সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ।

প্রায় সব ক্ষেত্রেই খোজাদের কাজ ছিল হারেম পাহারা দেওয়া। এর ফলে হারেমের মালিক বুঝতেন, হারেম-সুন্দরীদের গর্ভজাত প্রতিটি সন্তানই তাঁর আসল সন্তান। অন্যদিকে, হারেমের বৈধ স্ত্রী থেকে রক্ষিতা পর্যন্ত সবাই বুঝে যেতেন, তাঁরা রাজ-রক্তের উত্তরাধিকারী রেখে যাচ্ছেন। এছাড়াও মালিকের বিছানা পাতা, তাকে স্নান করানো, চুল কেটে দেওয়া, পালকি টানা, এমনকি, মলমূত্র বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও ছিল খোজাদের কাজ। আর বিশ্বস্ত খোজারা গুপ্তচরের কাজ করতো। তবে যতদিন শরীরে সামর্থ্য থাকতো, ততদিন থাকতো তাদের কাজ। শারীরিক ক্ষমতা কমে গেলেই চলতো নির্যাতন এবং অনেক সময় তার পরিণতি হতো মৃত্যু। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে খোজা প্রথা ছিল না। প্রাচীন ভারতে হিজড়াদের কাজে লাগানো হতো। এতে কাজ যেমন হতো, তেমনি তাদের কর্মসংস্থানের ব‍্যবস্থাও হতো। সব দিকেই একটি সামাজিক ভারসাম্য বজায় ছিল। ভারতে তুর্কি এবং পরে মোগলরা খোজা প্রথা চালু করে।

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির প্রধান সেনাপতি মালিক কাফুর একজন খোজা ছিলেন। এ ছাড়া ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে বসা বারবক শাহ এবং হাবশি সুলতান শামসুদ্দিন মুজফ্ফর শাহ (১৪৯০ খ্রি: -১৪৯৩ খ্রি: ) ছিলেন খোজা। বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন খানের (১৭১৭ খ্রি: -১৭৩৯ খ্রি: ) হারেম পাহারায় নিযুক্ত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে সংগ্রহ করে আনা খোজারা। আবুল ফজলের "আইন-ই-আকবরী" অনুসারে, খ্রিস্টিয় ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতক সময়ে মোগল শাসিত সুবা বাংলা ছিল খোজা সরবরাহের প্রধান এলাকা। বলা বাহুল্য, বিপুল পরিমাণ যুদ্ধবন্দি ক্রীতদাসরা খোজা হিসেবে পণ‍্য হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের সিলেট ও ঘোড়াঘাটের ব‍্যবসায়ীরা একচেটিয়াভাবে খোজা সরবরাহের ব‍্যবসা করতো।

পোর্তুগিজ পরিব্রাজক দুরার্তো বারবোসার লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলার শাসক ও অভিজাতদের হারেম পাহারায় ছিল দেশি-বিদেশি খোজারা। খোজা করার সময় অনেকের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হতো, তারপর নপুংসক হয়ে যারা বেঁচে থাকতো, তাদের বয়ে বেড়াতে হতো আমৃত্যু দাসত্বের জীবন। অমানবিক ও নিষ্ঠুর হলেও, এটাই ইতিহাস।