বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি পদবি "জানা।" এই "জানা" পদবির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে রাজকীয় পদমর্যাদার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের খোঁজেই এখন আমাদের গন্তব্য প্রতিবেশী রাজ‍্য উড়িষ্যা। বলা বাহুল্য, উড়িষ্যার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক অতি প্রাচীন। নবাবী আমলেও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা মিলে তৈরি হয়েছিল সুবা বাংলা।

সুতরাং, উড়িষ্যার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক যে অতি প্রাচীন, তা এইসব তথ্যেই প্রমাণিত। উড়িষ্যার হিন্দু রাজারা দীর্ঘকাল বাংলায় মুসলমান আক্রমণ ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। যেমন, উড়িষ্যারাজ তৃতীয় অনঙ্গভীমের সেনাপতি বিষ্ণু গিয়াসউদ্দিনকে যুদ্ধে হারিয়ে রাঢ় অঞ্চল দখল করেছিলেন। এই তৃতীয় অনঙ্গভীমের পুত্র প্রথম নরসিংহদেব সম্পর্কে কবি বিদ‍্যাধর তাঁর লেখা সংস্কৃত কাব‍্য "একাবলী"-তে বলছেন, তিনি ছিলেন "যবনাবনীবল্লভী", অর্থাৎ যবন বিজয়ী। এছাড়াও কবি তাঁকে বলেছেন, "হামীর মহামর্দন" অর্থাৎ বাংলার মুসলমান সৈন্য বিজয়ী বীর ( "Vanquisher of the Muslim Armies of Bengal ")। এই প্রথম নরসিংহদেবের পাটনার কেন্দুয়া তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তাঁর রাজ‍্যের উত্তর সীমা ছিল গঙ্গা বা পদ্মা নদী এবং সমগ্র রাঢ় ছিল তাঁর শাসনে। গৌড়ের লক্ষ্মণাবতীর শাসক তুগরাল তুগান খানের (১২৩৩-১২৫৭ খ্রি: ) রাজত্বকালে সেখানেও এক সফল অভিযান চালিয়েছিলেন উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেব। এর ফলে তুগরাল তুগান খান উত্তরবঙ্গের (লখনৌতি) শাসনভার আওর খানের হাতে ছেড়ে দিয়ে রাঢ় অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

ফিরে আসি "জানা পদবি প্রসঙ্গে। বাংলার "জানা" পদবির সঙ্গেও উড়িষ্যার সম্পর্ক রয়েছে। উড়িষ্যার কাছাকাছি মেদিনীপুরেই বেশি "জানা" পদবিধারী মানুষের বসবাস রয়েছে। উড়িষ্যার রাজকুমারকে বলা হয় "জানা।" সেই অর্থে "চৈতন্য চরিতামৃত" (৩০৭) অনুসারে, বড়ো রাজকুমার হলেন "বড় জানা।" এছাড়া "চৈতন্য চরিতামৃত" গ্রন্থে (৩০৯) বিশিষ্ট মানুষদের "জানা" উপাধি দেওয়ার কথাও উল্লিখিত আছে। এই সূত্রে "পুরুষোত্তম জানা"-র নাম জানা যায়।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, এই পদবির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। মানুষ তাঁর সেই পরিচয় জানলে আবার নিজেদের সামাজিক কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে। এ লেখায় সেকথা জানানোর চেষ্টা মাত্র।

১) পদবীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস: খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক