প্রাচীনকাল থেকেই‌ বাঙালিরা বাংলার বাইরে পাড়ি দিয়ে বহির্বঙ্গে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। সবার কথা জানা না গেলেও যে কয়েকজনের কথা জানা যায়, তাতেই বোঝা যায় পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বাঙালির দৌড় বৃত্তান্ত। ওইসব এলাকায় বহু বাঙালি উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলেন বাঙালিরা। বাইরে যাবার পথটিও ছিল এই বাংলায়। ভারত থেকে স্থলপথে বাংলার বাইরে যেতে গেলে যেতে হতো বাংলার ওপর দিয়েই। জলপথেও আর্যাবর্ত থেকে বাংলার বাইরে যেতে হতো তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে।

এবার বাংলার বাইরে বাঙালির কৃতিত্বের বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে আলোচনায় আসছি। জানা যায়, যবদ্বীপের শৈলেন্দ্র বংশীয় রাজবংশের গুরু ছিলেন একজন বাঙালি। যবদ্বীপের এই শৈলেন্দ্র রাজবংশের সঙ্গে সখ‍্যতা ছিল বাংলার পালরাজাদের। আর এর প্রভাবেই যবদ্বীপের বেশ কতকগুলি মূর্তির গায়ে লেখা যে লিপি আছে, তা বাংলায় প্রচলিত অক্ষরে লেখা। আবার প্রাচীন ব্রহ্মদেশের একটি অংশের নাম হয়ে গিয়েছিল বাংলার গৌড়ের অনুকরণে "গৌড়।" এছাড়া মলয় উপদ্বীপের এক শিলালিপি থেকে জানা যাচ্ছে, সেখানকার একজন মহানাবিক ছিলেন বাংলার রক্তমৃত্তিকাবাসী বুধগুপ্ত। দুর্গম হিমালয় পেরিয়ে বহু কৃতি বাঙালি পণ্ডিত পাড়ি দিয়েছিলেন তিব্বতে। এঁদের মধ্যে শান্ত রক্ষিত ও তাঁর ভগ্নীপতি পদ্মসম্ভব এবং তাঁর শিষ্য কমলশীল, পণ্ডিত শীলভদ্র, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন বিশিষ্টজনেদের দলে। এঁরা সবাই তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম সংস্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।

বাংলার ভট্টকৌশল গ্রামের বাসিন্দা বাঙালি কবি লক্ষ্মীধর মালবে গিয়ে সেখানকার রাজা পরমাররাজ ভোজের (১০০০-১০৪৫ খ্রি: ) রাজসভায় জায়গা করে নেন। তাঁর লেখা "চক্রপাণি-বিজয়" সেকালের একটি উল্লেখযোগ্য কাব‍্যগ্রন্থ। দক্ষিণ রাঢ় অঞ্চলের আরেক বাঙালি কবি ছিলেন হলায়ূধ। তিনিও মালবে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন এবং প্রাচীন মাহিষ্মতী নগরের একটি মন্দিরের গায়ে ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্থান পায় তাঁর লেখা ৬৪ টি শ্লোক। বাংলা থেকে মদন নামে আরেকজন বাঙালি কবি শৈশবেই মালবে যান এবং সেখানে কাব‍্যচর্চা করে উপাধি পান "বাল সরস্বতী।" এছাড়াও তিনি পরমাররাজ অর্জুনবর্মা (১২১০-১২১৮ খ্রি: )-র গুরু নিযুক্ত হোন এবং লেখেন "পারিজাত মঞ্জরী" কাব‍্য। চন্দেল্লরাজ পরমাদ্রীদেবের রাজসভায় ছিলেন বাঙালি কবি গদাধর এবং তাঁর দুই পুত্র---কবি দেওধর ও কবি ধর্মধর।

সংস্কৃত ভাষা ও লিপিকুশলী হিসেবে দক্ষ ছিলেন গৌড়ের করণ-কায়স্থরা। এঁদের কাজ ছিল বিভিন্ন মন্দিরের লিপি লেখা। চন্দেল্ল, চাহমান ও কলচুরি রাজাদের আমলে তৈরি অনেক মন্দিরেই তাঁরা লিপি উৎকীর্ণ করেছেন। এছাড়াও বিহার ও যুক্তপ্রদেশের বেশ কয়েকটি মন্দির গায়ে উৎকীর্ণ লিপির লেখক ছিলেন বাঙালি।