বোনপো নিবারণ ঘটকের সঙ্গে মাসিমার দারুণ সখ্যতা। মাসিমার বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত বোনপো নিবারণের। বোনপোর সঙ্গে ছদ্মবেশে প্রায়ই আসেন বিভিন্ন বিপ্লবীরা। একদিন এলেন "মাস্টারমশাই" ছদ্মবেশে বিপ্লবী জ‍্যোতিষ ঘোষ, অন্য একদিন "রণেনবাবু" নাম নিয়ে রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজবাড়ির কর্মচারী পরিচয়ে বিপ্লবী বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি আবার ছেলেদের ছোরা, লাঠি ও মুষ্টিযুদ্ধ শেখাতেন। সবার কাছেই নিবারণের মাসিমা হয়ে উঠলেন সবার "মাসিমা।" তাঁর বাড়িতে এত লোকজন দেখে মাসিমা দু'কড়িবালা দেবীর কেমন যেন সন্দেহ হলো। একদিন লুকিয়ে তাঁদের সমস্ত বইপত্র পড়ে ফেললেন এবং বুঝে গেলেন ওরা বিপ্লবী। তারপর মাসিমার আব্দার, তাঁকেও দলে নিতে হবে। কিন্তু তাতে দলের অনেকের আপত্তি। মাসিমা দু'কড়িবালা জানিয়ে দিলেন, তোমরা যদি দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারো, তোমাদের মায়েরাও পারবে।

ব‍্যস্, মাসিমাও হলে গেলেন দলের সদস্যা।

এতক্ষণ যার কথা বলা হলো, তিনি এক সাধারণ পরিবারের আটপৌরে গৃহবধূ‌। নাম---দু'কড়িবালা দেবী।

জন্ম: ১৮৮৭-র ২১ শে জুলাই।

পিতা---নীলমণি চট্টোপাধ্যায়, মা---কমলকামিনী দেবী।

স্বামী---ফণিভূষণ চক্রবর্তী।

ঠিকানা: বীরভূম জেলার নলহাটি থানার ঝাউপাড়া গ্রাম।

বিপ্লবীদের স্বদেশী বইপত্র পড়ার জায়গা ছিল "মাসিমা" দু'কড়িবালা দেবীর বীরভূমের নলহাটি থানার এই ঝাউপাড়া গ্রামের বাড়ি। তারিখটা সেদিন ইংরেজি ১৯১৪-র ২৬ শে আগস্ট। কলকাতার রডা কোম্পানির দায়িত্বে থাকা জেটি সরকার শ্রীশ মিত্র বড়সাহেবের হুকুমে জাহাজ ঘাটে মাল খালাস করতে গেলেন।"মাল" বলতে বিদেশ থেকে আসা মাউজার পিস্তল ও তার কার্তুজ। তিনি মালভর্তি ২০২ টি বাক্স ৭ টি গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে রডা কোম্পানির গুদামের দিকে আনতে থাকেন।

৬ টি গাড়ি গুদামে পৌঁছে যায়, কিন্তু মাঝপথে ১ টি গাড়ি উধাও হয়ে যায়। আসলে ওই গাড়িটিতে গাড়োয়ানের ছদ্মবেশে ছিলেন বিপ্লবী হরিদাস দত্ত। তিনিই পূর্বপরিকল্পনামতো ৭ নম্বর গাড়িটি নিয়ে হারিয়ে যান। ওই গাড়িতে ছিল ১ টি মাউজার পিস্তলের বাক্সসহ ৯ টি কার্তুজ ভর্তি বাক্স।

এইসব পিস্তল ও কার্তুজের কিছু এসে পৌঁছোয় বীরভূমের বিপ্লবীদের কাছে। তাঁরা সেগুলি দু'কড়িবালা দেবীর বাড়িতে রাখেন। খবর পেয়ে পুলিশ ১৯১৭-র ৮ ই জানুয়ারি দু'কড়িবালার বাড়ি তল্লাশি চালায়। গ্রেফতার হোন দু'কড়িবালা। কিন্তু পুলিশের শত জেরার মুখেও তিনি ওইসব অস্ত্রের উৎস বললেন না। কোলের শিশুকে ছেড়ে জেলে যেতে হলো দু'কড়িবালাকে। এরপর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় দু'কড়িবালার। বোনপো নিবারণ ঘটকের হয় ৫ বছরের হাজতবাস।

জেলের ভেতরে প্রতিদিন দু'কড়িবালাকে আধ মণ ডাল ভাঙতে হতো। তবুও ভেঙে পড়েননি তিনি। বাড়িতে চিঠি লিখে ভালো আছেন জানিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে ছেলেকে যত্ন করার কথা বলেছেন। ১৯১৮-র ডিসেম্বরে তিনি মুক্তি পান। এরপর ১৯৭০-এর ২৮ শে এপ্রিল ( বাংলা ১৪ ই বৈশাখ, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ) ব্রিটিশ ভারতের প্রথম অস্ত্র আইনে দণ্ডিতা মহিলা দু'কড়িবালা দেবীর জীবনাবসান হয়।