নির্বাচনের আগে দলবদলের মরসুম চলছে। হাওয়া তৃণমূল থেকে বিজেপির দিকে। ধরে নেওয়া হয় এসবই হয় ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্যে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সোমবার যে এক ঝাঁক তৃণমূল বিধায়ক বিজেপিতে এলেন, তাঁদের বেশিরভাগ সম্পর্কে ‘দলবদলু’ কথাটা বোধহয় খাটে না। সোনালী গুহ ছিলেন সব অর্থেই মমতার ছায়া। আজকের মমতা নন। যেদিন মমতা শুধুই এক বিরোধী নেত্রী, সেদিন থেকে সোনালী তাঁর পাশে। এরকম লোকেদের দল ছাড়ার পেছনে পদের থেকে সম্মান বড় হয়। এতদিন মমতা যা চেয়েছেন, সোনালী তাই করেছেন। জেতা বিধায়ককে ২০২১-এ প্রার্থী না করে মমতা প্রমাণ করেছেন ‘ছায়াসঙ্গী’ হওয়া ছাড়া সোনালীর আর কোন যোগ্যতা ছিল না। সোনালী এবার প্রমাণ করতে চাইবেন তাঁর রাজনৈতিক যোগ্যতা আছে এবং ছিল।

অসম্ভব লড়াকু মহিলা সোনালী। নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থাকাটাই তাঁর অভ্যেস। যদি আচরণে পরিবর্তন আনেন, তা হলে তা বিজেপির কাজে আসবে। আরেকটু আগে এলে আরো বেশি কাজে আসত। রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সম্পর্কেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। এলাকায় ভাল ভাবমূর্তি। চারবারের তৃণমূলের বিধায়ক তিনি। ২০০৬ সালে তৃণমূল যখন রাজ্যে প্রায় উড়ে গেছিল, ‘মাস্টারমশাই’ জিতেছিলেন। ২০১১ থেকে ২০১৬ মন্ত্রী ছিলেন। কোন দুর্নীতির অভিযোগ নেই। শোনা কথা, মন্ত্রী হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ সরকারি মোবাইল অফিসে তালাবন্ধ করে রেখে যেতেন। কারণ ‘সরকারি জিনিস ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে না’ !

রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মমতার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তাঁকে নেত্রীও মেনেছেন। কিন্তু তিনি কখনও মমতা-হাওয়ায় জেতা ‘ল্যাম্পপোস্ট’ ছিলেন না। দল ছেড়েছেন মমতার সঙ্গে মতবিরোধের কারণে। নিজের মতকে প্রাধান্য দিয়ে। সিঙ্গুর আন্দোলনের সূত্রপাত ভট্টাচার্য মশাইয়ের হাত ধরে। এ বার যিনি সিঙ্গুরে তৃণমূল প্রার্থী সেই বেচারাম মান্না তখন আন্দোলনের ধারেপাশেও ছিলেন না, হাওয়া বুঝে এপাশ থেকে ওপাশ হন, এবং কালক্রমে দিদির বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। বলাই বাহুল্য মান্নাবাবুকে ভাবমূর্তি নিয়ে বিশেষ ভাবতে হয়নি, উন্নতিও হয়েছে চড়চড়িয়ে। জটু লাহিড়ীকে আমি চিনি না। ইনিও বহুদিনের বিধায়ক। ওঁর যা বয়েস এবং অভিজ্ঞতা, মনে হয় না উনি টিকিটের জন্যে বিজেপিতে এসেছেন। কারণ, বিজেপির ঘোষিত নীতি হলো, ৭৫ বছর বয়সে অবসর। জটু সে বয়েস বহুকাল আগে পার করে এসেছেন।

যদি ধরেও নিই, মুখ পরিবর্তনের দরকার ছিল, তা হলেও তৃণমূল বোধহয় ভুল সময় নির্বাচন করেছে। পার্টিটা দাঁড়িয়ে ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তার ওপর। গত ১০ বছরে অনেকেই নানা সময়ে পার্টি ছাড়ার কথা ভেবেছেন, কিন্তু শেষে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেছেন। ধারণা ছিল মমতার বিরুদ্ধে গেলে জনগণেশ রুষ্ট হবে। এই দলবদল, চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাচ্ছে যে মমতা তাঁর জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, না হলে দলের টিকিট পেয়েও সরলা মুর্মু কেন বিজেপিতে যাবেন? ব্যাটে রান না থাকলে সবাইকেই সরে যেতে হয়। তৃণমূলের অন্দরেও তাই মমতার বিরুদ্ধমত সরব হচ্ছে। যদি মতপ্রকাশের পরিবেশ থাকত তা হলে হয়ত পার্টিটা এ ভাবে ভাঙতো না।

মমতা ও ভাইপো ভেবেছিলেন তাঁরাই সব। এবার বাকিদের বোঝানোর পালা যে তৃণমূলের অতীত গৌরবে তাঁদেরও অবদান ছিল। এই তাগিদটা বিজেপির কাজে আসবে বলেই মনে হয়।