অপরিচিতা

Magazine
sunday story aparichita
–ধরিত্রী গোস্বামী
‘মাতা হারির নাম শুনেছেন সিস্টার? ’ ৬০% আগুনে পুড়ে যাওয়া হাত পা বুক ব্যান্ডেজে মোড়া রোগিণীর মুখ থেকে স্পষ্ট গলায় প্রশ্নটা শুনে আমি থমকে গেলাম। মাতা হারি? সে আবার কে রে বাবা। আমার হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে যেন হেসেই ফেলল সে। আমি ত আরও বিস্মিত। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়ার কথা যার সে মানুষের মুখে হাসি আসে কি করে? “কে তিনি? ” জানতে চাই আমি। ভাবছিলাম কোন সন্ন্যাসিনীর নাম করছেন হয়ত। ওর গুরুমা কিংবা ওই ধরনের কিছু। কিন্তু আর কোন উত্তর পেলাম না। ওষুধের ঘোরে তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন আজ সকালে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এনে ভর্তি করা এই বছর সাতাশের দগ্ধ রোগিণী। যাকে পাহারা দেওয়ার জন্য কেবিনের বাইরে দুজন সশস্ত্র পুলিশ খাঁড়া আছে সেই সকাল থেকেই। রোগিণী যথেষ্ট ভিআইপি সন্দেহ নেই কিন্তু তাতে আমার কিবা যায় আসে? আমার যা কাজ তাই আমাকে করে যেতে হবে। ডাক্তারের নির্দেশ পালন। যদিও টানা আট বছর বার্ন ইউনিটে আমার কাজের অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে, আজকে যতই বক বক করুক, দু-এক দিনের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে যাবে এই রোগিণী। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে সংক্রমণ। তারপর কোমা। তারপর অবধারিত মৃত্যু। আনমনা হয়ে ভাবতে ভাবতে আরেকবার চোখ গেল মহিলার দিকে। গলার নীচ থেকে পুড়েছে। হাত দুটি ছিন্নভিন্ন হয়েছিল, বাদ গেছে। আশ্চর্যভাবে রক্ষা পেয়ে গেছে টলটলে রাঙা মুখটি। রীতিমত সুন্দরী। মাথার ঘন ঢেউ খেলানো চুলগুলিতেও লেগেছে তাত, ঝলছে কুঁকড়ে গেছে চুল। সেই কুঁকড়ে যাওয়া লালচে চুলের রাশি ঘুমে আচ্ছন্ন মুখের চারপাশে এক অদ্ভুত সুন্দর পরিমণ্ডল করে রেখেছিল। ব্যথা কমাবার ইঞ্জেকশন ফেন্টানিল সেলাইনের বোতলে মেশাতে মেশাতে আমার কৌতূহলী মন একবার ভাবল— কে এই মহিলা? কার কথাই বা সে বলতে চাইছিল?
আমার আন্দাজ মতই আর দিন তিনেক সজ্ঞানে ছিলেন মহিলা। তারপর থেকেই বেহুঁশ। আস্তে আস্তে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তাদের কাজ কারবার বন্ধ করে দিল। এগারো দিনের মাথায় ভবলীলা সাঙ্গ হোল। পুলিশের কর্তা-ব্যক্তি কিছুজন এসে দেহ নিয়ে চলে গেলেন। ওয়ার্ডের সবার কাছেই এইটা খুব আশ্চর্যের ছিল যে মহিলার আত্মীয় পরিবার একদিনের জন্য কেউ দেখতে আসেনি। মহিলার কোন পরিচয় কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ চুপ ছিলাম। কেননা জ্ঞান থাকা অবস্থায় একদিন রাতে আমাকে সব কথাই বলে গিয়েছিল সে। অভিনব সেই কাহিনী। রোমহর্ষক, আবার বেদনাদায়ক।
মেয়েটির নাম মনে করে নিন তৃপ্তি। তৃপ্তি ঘোষাল। নিজের আসল নাম কোনদিনও সে আমাকে বলেনি অবশ্য। তবে জেনেছিলাম তার বাড়ি বাংলাদেশের ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। অধ্যাপক বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে, দুই দাদার একমাত্র বোন। ছেলেবেলায় মাকে হারিয়ে নিজের মনেই বেড়ে উঠেছিল সে। যদিও তার বাবা তাকে চোখে হারাত তবু কলেজের এক মহিলা প্রফেসরের সঙ্গে বাবার ঘনিষ্টতা তার শিশু-মনে এক গভীর বিরাগের জন্ম দিয়েছিল। কোন অবোধ ছোটবেলায় তার কানে এসেছিল তার মায়ের মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক নয় এবং তার মামার বাড়ির লোকজন তার বাবাকেই এর জন্য সন্দেহ করত। নির্জন শৈশব পেরিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে তার মনে একটা গোপন ইচ্ছে দানা বেঁধেছিল, বাবাকে একদিন সে ঠিক পুলিশে ধরিয়ে দেবে। আরেকটু বড় হয়ে চিন্তা করত গোয়েন্দা হবে সে, মায়ের অকালমৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধান করবে এবং বাবার সঙ্গে হাফজা খালাকেও হাজতবাস করাবেই করাবে। ফাঁকা প্রাসাদোপম বাড়িতে লম্বা দুপুরগুলো সে কাটাত স্কুলের লাইব্রেরি থেকে আনা গোয়েন্দা গল্প পড়ে আর এইসব চিন্তা করে। বয়সে বড় দুই দাদা লেখাপড়ায় ছিল তুখোড়। ছোট বোনটা একা একা কি ভাবছে বা করছে দেখার সময় ছিল না তাদের। এইভাবে বিভিন্ন বইপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে একদিন তার হাতে উঠে এল এক আশ্চর্য মহিলার জীবন-বৃন্তান্ত। মহিলার প্রচলিত নাম মাতা হারি। আসল নাম মারগারিথা গুয়েরত্রুইডা জিলে। অসামান্য সুন্দরী এবং সাহসী এই মহিলা ছিলেন বিংশ শতকের সবচাইতে কুখ্যাত মহিলা গুপ্তচর। ১৮৭৬ সালে নেদারল্যান্ডে তার জন্ম। কল্পনাপ্রবণ নির্জন কৈশোর। মাতা হারির কাহিনি পড়ে স্বপ্নের ঘোরে ডুবে যায় তৃপ্তি। নিজেকে কল্পনা করে নেয় একজন মহিলা গুপ্তচরের ভূমিকায়। আপনমনে চিন্তার জাল বুনে বছর কাটে। দুই দাদা উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ি ছাড়ে। মস্ত বাড়িটা যেন দিনরাত গিলতে আসত তাকে। এই সময়ে একদিন হাফজা খালাকে বিয়ে করে বাড়িতে এনে তোলেন তৃপ্তির বাবা। তৃপ্তির তখন বয়স নেহাত সতেরো। সেইদিন রাত্রের ট্রেনেই খুলনায় মামারবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে নিজের বাবার বাড়ি ছাড়ে তৃপ্তি। বরাবরের মত।
sunday story aparichita
মামার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার পাশাপাশি গোয়েন্দা কাহিনি পড়ার নেশাটা ছাড়তে পারেনি তৃপ্তি। তার আদর্শ তখন মাতা হারি। গুপ্তচরদের জীবন, চর্চা, ঝুঁকি এই সব নিয়ে বিশদে জানার চেষ্টা চালিয়ে যেত সে। আর এই করতে করতে তার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল তারই মেজমামার এক বন্ধুর সঙ্গে, যে কিনা পুলিশের গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টে কাজ করত। এই অসমবয়সী সম্পর্কটা একেবারেই সুস্থ ছিল না, কিন্তু কিশোরী মেয়েটির জিঘাংসা তার দৃষ্টির স্বচ্ছতা এতটাই অকার্যকর করে তুলেছিল যে সে কার্যত অন্ধের মত বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল এই পুরুষটিকে। হুঁশ যখন হোল তখন নিজের বেশ খানিকটা ক্ষতি করে ফেলেছে। এমনকি তার মুখের ওপরে মামারবাড়ির দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। নিরাশ্রয়, সহায়-সম্বলহীন মেয়েটিকে সহানুভূতির অভিনয় দিয়ে কাছে টেনে নিল ইয়াকুব নামের যুবক, যে প্রকৃতপক্ষে ছিল এক কট্টরপন্থী জেহাদি গোষ্ঠীর সদস্য। দেশের উদারনীতির সরকারের সহযোগী পুলিশই ছিল তাদের টার্গেট আর তৃপ্তির মনে নিজের জন্মদাতার ওপরে জমে থাকা সমস্ত ক্রোধ আক্রোশ এখন স্থান বদল করে গিয়ে পড়েছিল সেই পুলিশ-মামার ওপরে। যতই ঘা খাওয়া জীবন হোক, বয়স তখন সদ্য কুড়ি আর মনটাও ফুলের কুঁড়ির মতই কোমল, প্রস্ফুটিত হতে অনেক বাকি। ইয়াকুবের চেহারা, যৌবন, গুছিয়ে কথা বলা আর উপচে পড়া ভালবাসার সামনে সে তখন একান্তই অরিক্ষত। ধর্মান্তরিত হয়ে তার নতুন নাম হোল শবনম। কুমিল্লা শহরের ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় তিনতলা বাড়ির উপরের তলায় দুটি ঘরে সে সংসার পাতল। সেখান থেকে নিচে নামার হুকুম রইল না। অর্থের কোন অভাব ছিল না, অভাব স্বাধীন চলাফেরায়। শবনম ঠাওর করল বুঝি সে এক তালিবানি পরিবেশে এসে পড়েছে কিন্তু তখন আর কিছু করার উপায়ও ছিল না। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়া আর আরও বারো চোদ্দোজন ছেলের জন্য ভালমন্দ খানা পাকানো, এই ছিল তার প্রাত্যহিক কাজ। যদিও এই ছেলেদের কাউকেই সে চোখে দেখতে পেত না, তবু তাদের উপস্থিতি জানা যেত দোতলায় কথাবার্তার শব্দে। ক্রমে ক্রমে শবনম পরিষ্কার বুঝতে পারল যে সে এক জঙ্গি ডেরায় বাস করছে।
শবনমের চরিত্রের এক কঠিন দিক ছিল তার অসম সাহস আর জেদ। এই বোধগুলিই তাকে আজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে এক তট থেকে অন্য তটে। বন্দিদশা থেকে জীবিত অবস্থায় সে মুক্তি পাবে না বুঝতে পেরে সে অন্য পথ অবলম্বন করল। গভীর প্রেমের অভিনয়, মৌলবাদী চিন্তাভাবনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ আর আলোচনার মাধ্যমে ইয়াকুবের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করতে লাগল। নিজেকে হিজাবে ঢাকা দিল একনিষ্ঠ মুসলিম স্ত্রী প্রমাণ করতে। ক্রমে বছর দুয়েকের চেষ্টায় সে ইয়াকুবের আস্থাভাজন হতে পারল এবং তিনতলার গন্ডি পেরিয়ে বাড়িটার একতলা দোতলা করার সুযোগ পেল, অন্য ছেলেদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারল। আশ্চর্যজনকভাবে এবারে তাকে কাজের দায়িত্বও দিতে লাগল ইয়াকুব, যেমন এলাকার বাজারগুলিতে ঘুরে পুলিশের উপস্থিতি এবং নিরাপত্তার কড়াকড়ি সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করা, সব্জির ব্যাগে করে কিছু বাক্স অন্যান্য জায়গায় পাচার করা, কাগজ আর লিফলেট নিয়ে আসার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এর মধ্যেই একদিন ইয়াকুব খবর পেল শবনমের সেই বদ পুলিশ মামা কুমিল্লায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। প্রায় ভুলতে বসা আক্রোশে মাথার শিরা দপদপ করে উঠল দুর্ভাগা মেয়েটার। সে যেন শুধু এই সুযোগের অপেক্ষায় প্রাণ ধারণ করে রয়েছে, এমন মনে হতে লাগল। স্বামির পায়ে ধরে অনুরোধ করতে লাগল যেন তাকে একবার সুযোগ দেওয়া হয় প্রতিশোধ নেবার। তার এই অতি আগ্রহ দেখে ইয়াকুবের চোখে খেলে গেল দুর্বুদ্ধির ঝিলিক।
নির্দিষ্ট দিনে এক হাঁড়ি সুস্বাদু বিরিয়ানি আর একটা ভুয়ো চিঠি নিয়ে ভাড়া ট্যাক্সিতে সেই থানার উদ্দেশ্যে রওনা হোল শবনম। সে জানত তার আজকের যাত্রা প্রায় আত্মঘাতী হামলার মতই ঝুঁকিপূর্ণ। তবু এতটুকু ভয় দূরে থাক, অপূর্ব আনন্দে ছেয়ে ছিল তার মন। ছেলেবেলা থেকে খাওয়াপরার অভাব নয়, বরং প্রাচুর্যেই তার বেড়ে ওঠা। তবু অপরিপূর্ণতার মেঘ তার মনের দিগন্ত সর্বদাই ছেয়ে রেখেছে। মায়ের অকালমৃত্যু হয়ে অব্দি সে বিলকুল একা একাই বেড়ে উঠেছে, না ছিল কোন খেলার সাথী, না ছিল কথা বলার মানুষ। একাকিত্ব আর কল্পনাকে সঙ্গি করেই দিনের পর দিন তার কেটে গেছে। গড়ে ওঠেনি বাস্তববুদ্ধি, গড়ে ওঠেনি মানুষ চেনার মত চেতনা। অবোধ নিরালা মনের সমস্ত যন্ত্রণাবোধ তার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল একগুঁয়ে এক রাগের। যে রাগ কেন্দ্রীভূত হয়েছিল নিজের জন্মদাতার ওপরে। তারপরে ভাগ্যের ভেলায় ভাসতে ভাসতে অনেক দূর চলে আসা। যে জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই, কোন উপলক্ষ্য নেই তেমন জীবনে বেঁচে থাকা যে কতটা বিড়াম্বনা সেটা তার থেকে হয়ত কমজনাই হয়ত টের পায়। আজ সেই অভিশপ্ত জীবন এক কিনারায় এসে পৌঁছেছিল। মরণঝাঁপ দেবার আগে একটি পাপী জীবনকে সে যে শেষ করে দিয়ে যেতে পারবে, এই আনন্দে আত্মহারা হয়েই বোরখায় শরীর ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল শবনম।
sunday story aparichita
বিরিয়ানির হাঁড়ির ভেতরে ছিল পার্সেল বোমা। থানার অফিসারের জন্য তোফা পাঠিয়েছেন স্থানীয় এক আমলা। এ রকম হয়েই থাকে, ফলে সন্দেহের কোন কারন ছিল না। বিশেষ করে তা যদি একজন সুবেশা সুন্দরী মহিলার হাত বয়ে আসে। বোরখায় মুখ ঢাকা শবনমকে অনেক বছর আগে নষ্ট করে আসা কিশোরী তৃপ্তির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিলো না অফিসারের পক্ষে। ফলে অনিবার্য দুর্ঘটনা ঘটেই গেল। দুপুরের নমাজের পরে বিরিয়ানির হাঁড়ির মুখ খুলতেই বিস্ফোরণে উড়ে গেল ধড়ের উপরের অংশ। এলাকা জুড়ে জারি হয়ে গেল সতর্কতা, আরম্ভ হয়ে গেল ধরপাকড়। তিনতলা বাড়িটাও আর সুরক্ষিত রইল না। দলের ছেলেদের পাঠিয়ে দেওয়া হোল বিভিন্ন জায়গায়। আর দলের মাথা ইয়াকুব সস্ত্রীক হিন্দু স্বামী-স্ত্রীর ছদ্মবেশে সীমানা পেরিয়ে ভারতে ঢুকবার ফন্দি খুঁজতে লাগল। ব্যাপারটা একেবারেই সহজ ছিলো না, এদিকে বিজিবি আর ওদিকে বিএসএফের কড়া প্রহরার ফাঁক গলে; অতর্কিতে ছুটে আসা গরম সীসার আঘাত এড়িয়ে সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু জঙ্গি সংঘটন যারা করে তাদের ছলের অভাব হয়না, লোকবলেরও নয়। প্রচুর টাকার হাতবদল করে অসম্ভবকে সম্ভব করতে সিদ্ধহস্ত ইয়াকুব পালাবার ব্যবস্থা করে ফেলল। মাথা পিছু দু লক্ষ টাকার বিনিময়ে নদীপথে জেলে নৌকায় করে রওনা হয়ে গেল তারা। একেবারে নিখুঁত ছদ্মবেশ, যেন চেক-লুঙ্গি পরা বয়স্ক গ্রাম্য জেলে তার ময়লা কাপড় পরা ইস্তিরিকে নিয়ে কাঁকড়া ধরতে পাড়ি দিয়েছে। পথে একবার মাত্র সীমান্ত রক্ষীরা তাদের আটকাল বটে কিন্তু তেমন সন্দেহজনক কিছু না মেলায় হালকা ধমক আর কিছু অর্থের সাহায্যে ব্যাপারটা মিটে গেল। যে পথে এত কড়াকড়ি, সেখানে আশ্চর্য মন্ত্রবলে আর রাতের অন্ধাকারের সুযোগে এক সময় ভারতের জল-সীমানায় প্রবেশ করল তারা। এই দুর্জয় যাত্রায় মহিলা সঙ্গী থাকায় সুবিধা হয়েছিল, একমাত্র এই কারনেই শবনমকে সঙ্গে নেওয়া। তার প্রতি প্রেম বলে কিছু ইয়াকুবের মনে ছিল না, অবলীলায় তাকে ফেলেই পালাত সে। কিন্তু ধরা পড়ে গেলে সে যে অনেক তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে আর স্বামী-স্ত্রী সেজে পালাবার সুবিধার কথা খেয়াল রেখেই তাকে পথের সঙ্গী করেছিল ইয়াকুব। শবনম আজকাল এসব ভালই বুঝতে শিখেছিল কিন্তু পালাবার দায় তারও ছিল, এবং ছিল আরেকটি অভীপ্সা, ইয়াকুবকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া। এ শুধু প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই নয়। এতদিন তাদের কথাবার্তা, ওঠাবসার মাধ্যমে এটা শবনমের বুঝতে বাকি ছিল না এই মৌলবাদী সংগঠনগুলি সমস্ত মানবজাতটার কল্যাণের জন্য কি ভয়াবহ পরিপন্থী। ছেলেবেলায় পড়া দেশের ইতিহাস, বিশ্বযুদ্ধের কাহিনি, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের রক্তার্ত বিবরণ তার বিবেকে নাড়া দিয়ে যেত, তার অভিজাত রক্ত বিদ্রোহ করে উঠত নিজের সারা জীবনের কার্যকলাপের বিপক্ষেই। অন্ধকার কৃষ্ণপক্ষের রাতে মেঘনার কালো জলের দিকে চেয়ে চেয়ে জীবনের শেষ সংকল্প স্থির করেছিল শবনম ওরফে তৃপ্তি, ইয়াকুবকে শেষ করেই এই পাপের জীবনটার ইতি টানবে সে। মোহনা পেরিয়ে সেই দীর্ঘ ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় দাঁতে কিছুই কাটল না সে, সামান্য একটা পুঁটুলি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে ছইয়ের নিচে বসে রইল। সামনে অগাধ জলপথ, শেষ নেই, সীমা নেই। নীরবতা বিদীর্ণ করা বৈঠার ছলাত ছলাত কেবলই তার বুকের ভেতরে ব্যথার ঢেউ তুলছিল। কিভাবে একটা সুন্দর সম্ভাবনাময় জীবন এইভাবে বিপথে ভেসে গেল ভাবতে ভাবতে একসময় ক্লান্তির ঘুম নেমে এসেছিল চোখে।
নতুন অপরিচিত বিদেশের পরিবেশে এসে যথেষ্ট বিড়াম্বনায় পড়েছিল শবনম। ভাষাটা বাংলা হলেও বোঝা যায় না। মানুষজন কিছুই চেনে না, প্রতিপদে নির্ভর করতে হচ্ছিল ইয়াকুবের নির্দেশের ওপরে। তবে ইয়াকুব যে আগে এদেশে এসেছে এবং তার পরিচিত যোগাযোগ আছে সেটা তার নির্বিকার ভঙ্গিতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। শবনমকে নির্দেশ দিয়েছিল হাবা সেজে থাকার। সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ অভিনয় পটু শবনমের কাছে। একজন আদর্শ গুপ্তচর হবার মত সমস্ত গুণই তার আয়ত্ত্বে ছিল। নাহলে ইয়াকুব স্থিরই করেছিল বোঝার মত না বয়ে বেরিয়ে তাকে শিয়ালদা স্টেশনেই ফেলে পালাবে। কিন্তু আবার তত্ত্ব ফাঁস হবার ভয়ে আর শবনমের দ্বারা আরও কিছু কাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে তাকে নিয়েই লোকাল ট্রেনে চড়ে বসল ইয়াকুব।
বর্ধমানে পৌঁছে আবার একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে আরম্ভ করল তারা ভুয়ো পরিচয়ে। ইয়াকুব এর মধ্যে বেশ কিছু জাল কাগজ আর নথি জোগাড় করে ফেলেছে। সেই মোতাবেক সে একজন সরকারি পশু চিকিৎসক, গ্রামে ঘুরে ঘুরে তার কাজ। কিন্তু এই কাজের আড়ালে সে সংগঠনের জন্য সদস্য জোগাড় করতে লাগল। এদিকে শবনমের আবার বন্দিদশা। তাকে বোবা বলেই বাড়িওয়ালার কাছে পরিচয় করাল ইয়াকুব। বছর কেটে যায় অসহ্য নিঃসঙ্গতা আর কর্মহীনতায়। সারাদিন রান্নাবান্না আর রাতে ইয়াকুবের যৌনক্ষুধা মেটানো ছাড়া অন্য কোন কাজ ছিল না। মাঝে মাঝে ভাবত ঘুমন্ত ইয়াকুবকে হত্যা করবে। তারপরে ভাবত ইয়াকুব যে বাংলাদেশি জঙ্গি সেটা প্রমাণ করার মত যথেষ্ট তথ্য তার হাতে নেই। সাধারণ খুনি হিসেবে বিচার হবে তার। আত্মহত্যা করা চলত, কিন্তু আদপে আশাবাদী জীবনকে ভালবাসা মেয়ে শবনম চাইত আরও কিছুদিন বাঁচতে। আরও একটু এই বৃহৎ দুনিয়াটাকে জানতে। কিছু একটা কাজের মত কাজ করে মরতে।
বছর দেড়েকের মাথায় পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল। বাড়িতে আসাযাওয়া আরম্ভ হোল অন্যান্য মানুষের। সবই কিশোর বয়সী। তাদের বোমা বানাবার ট্রেনিং দিতে লাগল ইয়াকুব। বাইরের লোকে জানল মাদ্রাসা পাশ কিছু ছেলের পশু চিকিৎসার সাধারণ বিদ্যা শেখার ট্রেনিং চলছে সেখানে। সত্যটা জানত শুধু শবনম। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করত, চেষ্টা করত ইয়াকুবের আস্থাভাজন থাকার। অন্যদিকে তার প্রত্যুৎপন্ন মন তাড়াতাড়ি শিখে নিচ্ছিল বোমা বানাবার পদ্ধতি, ফিউজ ওড়াবার কায়দা। তারপরে এল সেই দিন। হাবাগোবা সেজে থাকার অজুহাতে সে শুনে ফেলল এক মস্ত চক্রান্তের খবর। বর্ধমান স্টেশনেই বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। সোমবার সকালে, সপ্তার প্রথম দিনের ব্যস্ততার মধ্যে বেলা সাড়ে দশটায় একসঙ্গে ফেটে উঠবে ছয়টা টিফিন বোমা। হতাহত হবে বেশ কয়েকশো নিরীহ মানুষ। বোমা রেখে আসার দায়িত্ব পেল আসিফ নামের একটা বাচ্চা ছেলে। খাবারের টিফিন বাক্সে করে নিয়ে যাবে সে, লোকে ভাববে অফিসের ভাত যাচ্ছে। এদিকে সব ঠিক চললে সোমবার সকালেই বর্ধমান থেকে পাত্তাড়ি গুটাবে ইয়াকুব আর শবনম। কোথায় যাবে সেটা খোলসা জানতে পারল না শবনম। শুধু নির্দেশ পেল সব গুছিয়ে রাখার।
sunday story aparichita
গুছাবার আর কি ছিল? আর কোথাও পালিয়ে বাঁচার ইচ্ছে ছিল না শবনমের। তাছাড়া এই নির্মম হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না সে। ভেবে দেখল, মরবার আগে অন্তত কয়েকশো নারী পুরুষ শিশুর জীবন বাঁচিয়েই মরবে সে। ফলে রবিবারের সারাবেলা ইয়াকুবের অনুপস্থিতির সুযোগে টিফিন-কৌটায় গুছিয়ে রাখা বোমাগুলির ফিউজ তার কেটে দিল সে আর কাজটা এমন ভাবেই করল যে কারু বোঝার সাধ্যি থাকবে না। তারপরে একটা মারাত্মক রাসায়নিক দ্রবণ প্রস্তুত করে কয়েকটা বোতলে করে রসুইঘরে লুকিয়ে রাখল। সেদিন রাতে খানাপিনা যেমন জবরদস্ত হোল, ইয়াকুবকে সে আদরও করল খুব। সারা জীবনের সঞ্চিত অতৃপ্তি, ক্ষোভ, লজ্জা, পাপবোধ, হাহাকার মিলিয়ে এক অদ্ভুত আলোড়ন উঠেছিল তার শরীর জুড়ে। ইয়াকুব খানিক অবাক হলেও বাধা দেয়নি।
পরেরদিন সকাল। ছয়টা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বেরিয়ে গেল আসিফ। এবারে নিজেদের রওনা হবার পালা। খাবার বাড়তে রসুইখানায় গিয়েছিল শবনম। পাশের ঘরে ইয়াকুব আর আরেক দোস্ত। হঠাৎ ভয়ঙ্কর শব্দে কেঁপে উঠেছিল সারা বাড়ি। ভেঙে পড়েছিল পুরনো বাড়ির দেওয়াল আর ছাদ। তারপরের কথা আর কিছু বলতে পারেনি শবনম।
একটানা নিজের কথা বলে গিয়েছিল শবনম ওরফে তৃপ্তি। দেখতে পাচ্ছিলাম বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। তবু বিরতি নিতে অস্বীকার করায় আর বাধা দিতে পারিনি। সব শেষ করে এবারে জল চাইল সে। জিব শুকিয়ে গিয়েছিল। জল খেয়ে হাপাতে হাঁপাতে বলল, বোমাগুলো ওদের দিকে ছুঁড়ে মারবার আগেই আমার হাতের মধ্যে ফেটে গেল। কপাল দেখ! আমি অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম বাকি খবর দিয়ে। ইয়াকুব কিংবা তার দোস্ত কেউই রেহাই পায়নি। দেয়াল চাপা পড়ে মরেছিল তারা। শুনে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল পোড়া বুকের তল থেকে। সবাইকে তুমি বলে দিও সিস্টার, আমি বাংলাদেশের মাতা হারি। আমার আসল পরিচয়টা তোমার জানা থাক। ওরা যদি পারে অনুসন্ধান করে দেখুক।
মৃদু হাসি ঠোঁটে মেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল সেই রহস্যময়ি পেশেন্ট। আর জ্ঞান ফেরেনি তার।

Anim pariatur cliche reprehenderit, enim eiusmod high life accusamus terry richardson ad squid. 3 wolf moon officia aute, non cupidatat skateboard dolor brunch. Food truck quinoa nesciunt laborum eiusmod. Brunch 3 wolf moon tempor, sunt aliqua put a bird on it squid single-origin coffee nulla assumenda shoreditch et. Nihil anim keffiyeh helvetica, craft beer labore wes anderson cred nesciunt sapiente ea proident. Ad vegan excepteur butcher vice lomo. Leggings occaecat craft beer farm-to-table, raw denim aesthetic synth nesciunt you probably haven't heard of them accusamus labore sustainable VHS.
Anim pariatur cliche reprehenderit, enim eiusmod high life accusamus terry richardson ad squid. 3 wolf moon officia aute, non cupidatat skateboard dolor brunch. Food truck quinoa nesciunt laborum eiusmod. Brunch 3 wolf moon tempor, sunt aliqua put a bird on it squid single-origin coffee nulla assumenda shoreditch et. Nihil anim keffiyeh helvetica, craft beer labore wes anderson cred nesciunt sapiente ea proident. Ad vegan excepteur butcher vice lomo. Leggings occaecat craft beer farm-to-table, raw denim aesthetic synth nesciunt you probably haven't heard of them accusamus labore sustainable VHS.
Anim pariatur cliche reprehenderit, enim eiusmod high life accusamus terry richardson ad squid. 3 wolf moon officia aute, non cupidatat skateboard dolor brunch. Food truck quinoa nesciunt laborum eiusmod. Brunch 3 wolf moon tempor, sunt aliqua put a bird on it squid single-origin coffee nulla assumenda shoreditch et. Nihil anim keffiyeh helvetica, craft beer labore wes anderson cred nesciunt sapiente ea proident. Ad vegan excepteur butcher vice lomo. Leggings occaecat craft beer farm-to-table, raw denim aesthetic synth nesciunt you probably haven't heard of them accusamus labore sustainable VHS.